পুত্রের জন্য শোকগাথা

সেহঝিলের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী

শাহরিয়ার পারভেজ | সোমবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রবন্ধ বা গল্পে হাজারো অক্ষরে বেদনায় স্বজন কিংবা পুত্রকে নিয়ে স্মৃতিকথা লেখা খুব দুরূহ। প্রতি অক্ষরে থাকে বেদনা, প্রতি বাক্যের আঘাতে চোখের বলিরেখাগুলোতে অশ্রুর বান ডাকে। সেহ্‌ঝিলকে নিয়ে আবার নতুন করে অনেকদিন পর লিখছি। এলোমেলো লেখা।

স্মৃতিকাতর হচ্ছি চোখের জলে। তার শরীরের ওম পাচ্ছি

২০২৫ সালের ৪ অক্টোবর হবে আমার সেহ্‌ঝিলের ইন্তেকালের ৪ বছর। পুত্রের আগে যেখানে বাবার আগে যাবার কথা সেখানে খোদার ইশারা অন্যরকম হলো।

এভাবে বছর যাবে বছর আসবে। আমাদের আয়ু বাড়বে কিন্তু বেদনা একই স্থানে স্থির থাকবে। বেদনার বয়স বাড়ে না। কিন্তু যেটুকু স্থায়ীত্ব নিয়ে থাকে ততটুকুতে চারদিক ম্রিয়মাণ বা ধূসর করে দিতে যথেষ্ট।

জানি না কোথায় গিয়ে শেষ হবে এই লেখা। অনেকদিন ধরে লিখে শেষ হবে এই লেখা। মরহুম সন্তানকে নিয়ে লেখা কখনো এক বসাতে শেষ হয় না। আগামীতেও হবে না। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর ঝিরিগুলো আবার না হয় দু’কূল ভরে প্লাবিত হবে। রাতগুলো আরো বেশী নিদ্রাহীন হবে। মাঝরাতে এক দৃষ্টিতে বারান্দায় তাকিয়ে থাকি, যেখানে সেহ্‌ঝিল নিত্য বসে বাচ্চাদের সাথে গলা মেলাতো। আমার সেহ্‌ঝিল। আমি আজো প্রায়শঃ তাকিয়ে থাকি শূন্য বারান্দার দিকে। এই বারান্দা একসময় কিচিরমিচির করত। চারিদিকের কোলাহল মুখরতার মাঝেও এখন শুধু নিস্তব্ধতা।

সামনের বাসায় সারাদিন হৈ হুল্লোড় বাচ্চাদের কলকাকলী হাসি আনন্দ। পেছনের বাসা থেকে সময় অসময়ে ভেসে আসে বাচ্চাদের হাসি কান্না আবদার। আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে শুনি। আমাদের এই বাসাটা বড় নিশ্চুপ। এখানে কোনো হৈ হুল্লোড় নেই। আশেপাশে ঘুরঘুর করা ছোট্ট ছায়াটা হারিয়ে গেছে। মনকে বোঝাই আমি ছোট্ট ছায়াটা হারিয়ে ফেলেছি। এই ছোট্ট ছায়াটা হারানোর বেদনা আমাকে কুরে কুরে খায় প্রতি মুহূর্তে।

এই ছোট ছায়ার মানুষটা কখনো কোনো কিছুর জন্যে আবদার করেনি। শুধু দিনের পর দিন হাসপাতালে ইঞ্জেকশন কেনোলাকেমো থেকে মুক্তি পাবার জন্য আধোআধো শব্দে আবদার করত বাবার কোলে বসে হাসপাতাল থেকে এক ছুটে বেরিয়ে যেতে। আমি এখনো আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ছোট্ট মানুষটার ছায়া খুঁজি। আমার ছেলেটার কোন আবদার ছিল না।

গত কয়েক বছর আগে বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে আমাকে অনুষ্ঠানের ডায়াসে দাঁড়িয়ে ক্যান্সার নিয়ে কিছু কথা বলার অনুরোধ করেছিলেন একজন। এরপরেও ডাক এসেছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি। বলা যায় যাইনি। কারণ সেহ্‌ঝিল সম্পর্কে যখন ভাবি লিখি কিংবা কাউকে বলি তখন অশ্রু সজল হয়ে পড়ি। ইদানীং বেদনা এত প্রকট হয়ে গেছে যে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করে। নামাজের প্রতি রাকাত আর মোনাজাতে আমার ছেলেটার জন্য বাবার চোখের জল বরাদ্দ দিয়ে রেখেছেন আমার খোদা।

আমি প্রতিদিন বিরহে ডুবি। হারিয়ে যাওয়া পুত্রের বিরহ। মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখা দেয় ভোর রাতে। আর সেই সুখস্বপ্ন নিয়ে গড়িয়ে চলে দিনগুলো। হু হু করে ভেতরটা।

আমি কবি নই। কখনো ছিলাম না। কিন্তু সেহ্‌ঝল চলে যাবার পর কত শত কবিতা লেখা হয়েছে। প্রতিটা কবিতা লেখা হয়েছে চোখের জলে।

শেষদিকে সেহ্‌ঝিলের হাতে পায়ে কেনোলা করা খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটোছুটি করতাম। একসময় আইসিউয়ের যারা এক্সপার্ট তাদের স্মরণাপন্ন হতে হতো। সবাই তার ভেইন পেতো না। কয়েকবার তো মাথায়ও কেনোলা করতে হয়েছে। সে এক বিষম দিন ছিল। এখনো এসব ভাবলে নিজেকে সামলে রাখা একরকম কঠিন হয়ে যায়। এসব এখন নিত্য। সময় অসময়ে চোখে ভাসে।

খোদার এই দুনিয়াতে চরম পাপী না হলে হয়তো এরকম দৃশ্য দেখতে হয় না।

কেনোলা করার সময় তাকে মাঝেমধ্যে ডাক্তাররা ভেতরে নিয়ে যেত আমাদের আড়ালে রেখে। চারদিকে অচেনা মানুষগুলোর মাঝে ছোট্ট মানুষটার ইঞ্জেকশন কেনোলার অত্যাচার। এই দৃশ্যটা কতটা ভয়ানক ছিল আমার জন্যবর্ণনাতীত। সেকেন্ড মিনিটের অপেক্ষমান সময়গুলোতে চোখের জলে ভাসিয়েছি। খোদার কাছে ফরিয়াদ ছিল নিত্য। সোহরাব রুস্তমের মত জীবনের বিনিময়ে সেহ্‌িঝলের সুস্থতা চেয়েছি সবসময়।

কেনোলা শেষে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কত কান্না তার কত অভিযোগ। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। এই দৃশ্য এই অনুভব সারা জীবনের

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধনারীশিক্ষার অগ্রদূত