অনেক দিন আগের কথা, ‘প্রাচ্যের রানি’ নামে পরিচিত চট্টগ্রাম শহর তার পাহাড়, নদী, দিঘি ও পুকুরের জন্য সুপ্রসিদ্ধ ছিল। এসব জলাধার শুধু সৌন্দর্যই বাড়ায়নি, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থিতিশীল রাখা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও নগরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কিন্তু গত কয়েক দশকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন ও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে শহরের জলাধারের চিত্র আমূল বদলে গেছে। এটি কেবল পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, বরং চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ও সামাজিক ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়। বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণা অনুযায়ী, জলাশয়ের সংখ্যা দ্রুত কমছে এবং এর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর।
চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাসে জলাধার ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা জনকল্যাণ ও সামাজিক প্রতিপত্তি প্রদর্শনের জন্য বিশাল দিঘি খনন করতেন। তবে সময়ের সাথে সাথে চিত্র পাল্টে গেছে। ১৯৮০–এর দশকে নগরীতে প্রচুর সংখ্যক পুকুর ও জলাশয় থাকলেও, ১৯৯১ সালে মৎস্য অধিদপ্তরের এক জরিপে এই সংখ্যা কমে ১৯,২৫০–এ দাঁড়ায়। ২০০৬–০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জরিপে সংখ্যা কমে ৪,৫২৩–এ নেমে আসে মাত্র ১৫–২০ বছরে প্রায় ১৫ হাজার জলাশয় বিলুপ্ত হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিডিএ‘র ২০০৮ সালের ড্যাপ অনুযায়ী চট্টগ্রামে ৫,০৩১টি জলাশয় ছিল, যা বর্তমানে প্রায় ২,০০০টিতে নেমেছে। অর্থাৎ মাত্র ১৫ বছরে প্রায় ৩,০০০টি জলাশয় বিলীন হয়েছে। ২০২৪ সালে বাপসা ও সিডিএফ–এর যৌথ মানববন্ধনে জানা যায়, নগরীর ৪,৬৪১টি পুকুরের মধ্যে ২,৩৯০টি ভরাট হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো নিশ্চিত করে যে, প্রতি বছর দ্রুতহারে জলাভূমি কমছে, যা শহরের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি।
শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাশয় ভরাটের বহু উদাহরণ রয়েছে। রহমতগঞ্জ এলাকায় দেওয়ানজী পুকুরটি ১৯৯৭–৯৮ সালের দিকে ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আন্দরকিল্লা মোড়ের কাছে শতবর্ষী রাজাপুকুরও এখন চারটি বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়েছে। নন্দনকাননের রথের পুকুর ভরাট করে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কাট্টলী দিঘি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘প্রশান্তি আবাসিক এলাকা’। দামপাড়ার বাইগ্যাপুকুর সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। জামালখানের আশকার দিঘি দখল ও দূষণে সংকুচিত, কোরবানীগঞ্জের বলুয়ার দিঘি আবর্জনা ও দখলের কারণে ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এনায়েত বাজারের রানির দিঘিও একই সংকটে পড়েছে। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত লালদিঘি এখনও টিকে আছে, তবে দখল ও দূষণের শিকার।
পাহাড়তলী রেলওয়ে পুকুরটি এখনও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত আছে। বায়েজিদ বোস্তামির দিঘি ধর্মীয় ও পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায় সংরক্ষিত আছে। মিরাপুকুর (কাজীর দেউড়ি এলাকায়), জোড়া ডেবা, ভেলুয়ার দিঘি, মুন্সিপুকুর এবং আগ্রাবাদ ডেবা এসব জলাশয় দখল, দূষণ বা অবৈধ স্থাপনার কারণে সংকুচিত বা হুমকির মুখে রয়েছে।
জলাশয় ধ্বংসের পেছনে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং প্রশাসনের উদাসীনতা প্রধান ভূমিকা রাখছে। জলাশয় সংরক্ষণ আইন–২০০০ থাকলেও কার্যকর প্রয়োগ নেই। প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে জলাশয়ের শ্রেণি পরিবর্তন করে স্থাপনা নির্মাণ করছে। প্রশাসনের নীরবতা ও অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ভরাট অব্যাহত রয়েছে।
জলাশয় ধ্বংসের ফলে শহরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে, কারণ বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাচ্ছে, ফলে সুপেয় পানির সংকট তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে মাছ, পাখি ও জলজ উদ্ভিদ হুমকির মুখে। অগ্নিনির্বাপনে পানির উৎস কমে যাওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের সময় পানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া ভরাটকৃত জলাশয়ের ওপর নির্মিত বহুতল ভবন ভূমিকম্পের সময় ধসে পড়ার ঝুঁকিতেও রয়েছে।
অতএব, জলাশয় ধ্বংস কেবল পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে চট্টগ্রাম নগরীর সব জলাশয় হারিয়ে একটি কংক্রিটের মরুভূমিতে পরিণত হবে। সরকারকে কার্যকর আইন প্রয়োগ, ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবেশবাদী সংগঠন ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারে।
লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড।