দেশ হতে দেশান্তরে

টিক মার্ক ম্যানেজার

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আচ্ছা কতদিন ধরে জানাশোনা তোমার এরিক ভ্যান ওপ্পেনের সাথে?” প্রশ্নটি এদিকে ছুঁড়ে দিয়ে এতক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে থাকা ফিল রাশ সোজা হয়ে টেবিলের দিকে ঝুঁকে হাতের সিগারেটিতে শেষ টান দিয়ে গোড়াটিকে সামনের বিশালাকায় এসট্রেতে চেপে দিয়ে নাকেমুখে ধোঁয়া ছেড়ে নতুন আরেকটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো।

এদিকে এপাশে একটু আগে আমার দিকে ঠেলে দেয়া ফিলের ফিলিপ মরিস সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম আমি, আগেও বলেছিলাম মনে হয়। খুব বেশিদিনের পরিচয় না। এই ধরো হবে বছরখানেকের। মানে আমি যখন সিঙ্গাপুরে কাজ করছিলাম গত বছর, সেসময় জুলাই না জানি আগস্টে এসেছিল এরিক, জেফ জর্জের টিম যখন বেরিয়েছিল কান্ট্রি ভিজিটে তখন। তার কিছু আগেই কিন্তু সিঙ্গাপুরের গোটা রিজিওনাল অফিসটিকে ধবসিয়ে দিয়েছিল হেড কোয়ার্টার, কষ্ট কন্ট্রোলের জন্য।

হা হা হা কষ্ট কন্ট্রোল! একচুয়ালি দেটস দ্য রেজাল্ট অব আনকন্ট্রোল্ড ইগো অব সাম বিগ ফিস অব হেড কোয়ার্টার। বুঝলে সিংগাপুরের সে সময়ের সাব রিজিউনাল অফিসের হেড স্টেফান জিগলার, জাতে সুইস হওয়ায় হেড কোয়ার্টারের অনেককেই গুনতো না মোটেও। তাদের কোন সিদ্ধান্ত তার পছন্দ না হলে ,বলে দিত সে ওটা মুখের উপর। এমতাবস্থায় বড় এক চাই অনেকদিন ধরে তক্কে তক্কে ছিল স্টেফানকে শিক্ষা দেবার জন্য। ”

হুম এরকম কথাও বাতাসে উড়ে বেড়িয়েছে সে সময়। একম অবস্থার ব্যাপারে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলুখাগড়ার প্রান যায়। আই মিন, ফাইট হাপ্পেন্স বিটুইন কিংস বাট ইট কষ্টস পাবলিক লাইভস, এর চেয়ে ভাল ট্রান্সলেশন মাথায় আসছে না। স্টেফানকে দেখে নিতে গিয়ে শেষে কি না রিজিওনাল অফিসের ৫৫ জনের চাকরী গিয়েছিল সেবার! প্লিজ ডোন্ট কাউন্ট মি এজ রেইসিস্ট, বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মতো ঐ ঘটনা ঘটার পরই, জীবনে প্রথমবারের মতো আমি সাদা মানুষদের চোখে পানি দেখেছিলাম

হা হা হা । নো ওয়ারী, আই থিংক আই আণ্ডারস্ট্যান্ড ইয়ু এ বিট মিন টাইম! শোন যতোই বিশাল বিশাল কর্পোরেটরা রেশনাল ডিসিশন নেয়ার জন্য নানান পলিসি, প্রসেস, ভ্যালুস, মিশন, ভিশন এসব করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষতো আসলে আবেগতাড়িত। তা এরিকের কথা বল। সিঙ্গাপুরে কি শুধু কান্ট্রি সেশনেই কথা হয়েছিল ওর সাথে তোমার?”

না, তা নয়। কান্ট্রি সেশনের পরদিন সে সিঙ্গাপুর কান্ট্রি অফিসের আমিসহ মোট তিনজনের সাথে দীর্ঘ ওয়ান টু ওয়ান মিটিং করেছিল। অন্য দুজনের মিটিংয়ের ফলাফল কী, তা তো জানি না। তবে আমার সাথে কথার শেষে সে আমাকে সিংগাপুরের কান্ট্রি অফিস বাদ দিয়ে রিজিওনাল অফিসের একটা পদ অফার করেছিল । উত্তরে বলেছিলাম যে , এই কিছুদিন আগেই তো ওটা নাই হয়ে গেছে। তাতে বলেছিল সে, না ছোট আকারের একটা রিজিওনাল অফিস চালু করার চিন্তা করছে এশিয়া প্যাসিফিকের জন্য। শুনে সবিনয়ে বলেছিলাম নাহ, দেশে ফিরতে চাই এবার; বউ বাচ্চা পরিবারের কাছে। “হুম। ওটাই তোমাদের একমাত্র সামনা সামনি কথাবার্তা নাকি?”

না, এরপর এ বছরের শুরুতেই তো জেফ জর্জের টিমের সাথে এসেছিল সে বাংলাদেশে। মাত্রই তখন ফিরেছি দেশে, সিঙ্গাপুর ছেড়ে। জেফ জর্জ একদিনের কান্ট্রি সেশন করে চলে গেলেও, এরিক আর টিমের বাকীরা ছিলও আরো দুই দিন। ফলে সব মিলিয়ে তিন দিনে অনেকবারই তার সাথে একান্ত আলোচনা হয়েছে ।বাংলাদেশ টিম এবং অপারেশন নিয়ে সে খুব উচ্ছ্বসিত ছিল তো। তা হঠাত এরিকের ব্যাপারে এতো কিছু জিজ্ঞেস করছো কেন? দু দিন আগের টেলিকনফারেন্সে একটু খটমট লেগেছিল অবশ্য তার সাথে আমার। সে কি তা নিয়ে কিছু বলেছে নাকি তোমাকে?

না না মোটেও ঘাবড়ানোর কিছু নাই তোমার। আমাকে সে বলেনি এবং বলবেও না কিছু। কথা হয়েছে সিল্‌িভওর সাথে। সেই বলেছে, সৌদির ডায়াবেটিক প্রোডাক্টের যে লঞ্চপ্লান ছিল আগে তা যে তুমি পিছিয়ে দিয়েছ, দুই নাকি তিন মাসের জন্য তা নিয়ে আপসেট হয়েছে কিছুটা। সিল্‌িভও আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো। ওহ হো, আরে সিল্‌িভও তো দেখি তোমাকেও খুব পছন্দ করে, তাই জানালো আমাকে ব্যাপারটা, যাতে তোমাকে বলি এরিককে একটু ম্যানেজ করতে। এই আর কী।” হ্যাঁ হ্যাঁ, সিল্‌িভও ও তো এসেছিল এরিকের সাথে ওইসময় বাংলাদেশে। খুব মজার মানুষ।

শোন এরিকের পজিশনটা আসলে সিল্‌িভওর পাওয়ার কথা। নাহ আমি বলছি না যে, এরিক অযোগ্য। অবশ্যই যোগ্য সে। ব্যাপার হচ্ছে কী জানো ও হলো খুবই ভালো “টিক মার্ক ম্যানেজার”। এরা চলে সবসময়ই একটা “থিংস টু ডু লিস্ট” নিয়ে। সেটাই ফলোআপ করে, প্রতিটি কাজ সময়মতো হয়ে গেছে বা যাচ্ছে, বুঝতে পারলে ঐ লিস্টিতে টিক দিতে পারলে মনে করে যে বিশাল কাজ হয়ে গেছে ! ওরকম “টিক মার্ক ম্যানেজার”রা, ধরো বিশেষত ইউরোপিয়ান স্ট্যাবল এবং ম্যাচিউর মার্কেটে খুব ভাল ফিট করে। এশিয়া আফ্রিকা তো হলো ইমারজিং ইকোনমি। সৌদি তো হলো এক্কেবারে “বিজা আ”। এখানে দরকার প্রতি মুহূর্তে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারে এরকম ডায়নামিক লিডার। তুমি হলে এই দ্বিতীয়জাতের, এজন্যইতো তোমাকে পছন্দ আমার। আবার ঐজন্যই এরিকের স্টাইলের সাথে তোমার স্টাইলের ঠোকাঠুকি লাগছে। ও কিছু না। শুধু একটু ম্যানেজ করো। তাকে তার লিস্টিতে টিক মার্ক দিতে সহযোগিতা করো।”

দেখো এই নিয়ে তো আমি তোমাকে আগেই বলেছি। এখানকার প্ল্যান যেটা রিজিওনাল ও গ্লোবাল থেকে, অনুমোদন পেয়েছিল আগে তাতে বেশ কিছু ফাঁক নজরে এসেছে আমার। ওসব ফাঁক আমার নজরে এসেছে কারণ প্রথমত আমি কিন্তু এর আগেও ডায়াবেটিস মার্কেটে কাজ করেছি। তদুপরি এখানে আসার পর এই মার্কেট গ্রাউন্ড লেভেলের কাছাকাছি যেয়ে যতোটা বুঝেছি, তাতে তো ঐ ফাঁকগুলো ঠিক না করলে তো অনেক অপুরচুনিটি মিস করবো। রিজিওনাল বা গ্লোবাল টিম ধরতে পারেনি কারণ ওরা তো দেখছে থিওরেটিকাল স্টেজ থেকে। হ্যাঁ এটা মানতেই হবে থিউরেটিক্যালি এখানকার যে প্লান করা হয়েছিল সেটি বেশ ভাল।

সবই জানি এবং বুঝি। সেজন্যই তো সবসময় বলি আমি কান্ট্রি অপারেশনের অভিজ্ঞতা ছাড়া কাউকে হেডকোয়ার্টারের অন্তত মার্কেটিং এর কোন পজিশন দেওয়া উচিৎ না। এখন তোমাকে একটা টিপস দেই; শোন আজকালকার তুমুল কমপিটিটিভ মার্কেটে মোস্ট অব দ্য টাইম ইট ইজ বেটার টু বি ফাস্টার দেন বিং বেস্ট অর পারফেক্ট।”

তার মানে কি আগে যে প্লান ছিল সেটাতেই স্টিক করতে বলছো?

না একদম না। বলছি তুমি প্রডাক্ট লঞ্চ দুই মাস পিছিয়ে দেবে বলেছো তো, ঐটা একটু এগিয়ে আনো। এই ধরো একমাস এগিয়ে আনো। এর মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে যে সব ফাঁক তোমার চোখে পড়েছে সেগুলো ঠিক করতে বলো টিমকে। বাকিগুলো থাকবে ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস। তা এরিকের সাথে ওয়ান টু ওয়ান টেলিকনফারেন্স আছে নাকি তোমার এর মধ্যে? হুম নাহ, তুমি বরং তাকে মেইল করে একটা টেলি কনফারেন্স শিডিউল করে এটা বলো যে তার পরামশের্র কথা ভেবে, তুমি এক মাস এগিয়ে দিচ্ছ লঞ্চ। তাতেই মহাখুশি হবে সে। কারণ একদিকে সে ঠিক মতো টিক মার্ক দিতে পারছে না হাতের লিস্টিতে, আবার পারছে না সে তোমার মার্কেট এক্সপার্টিজ এন্ড নলেজ অস্বীকার করতে, এদিকে তুমিও ছাড় দিচ্ছ না! ওটা ইগোতে লেগেছে আর কি! একটু ছাড় দেওয়া নট এ বিগ ডিল বাডি”

ঠিক আছে। তোমার টিপসের জন্য অনেক ধন্যবাদ ফিল।

দ্যাটস মাই জব! ইটস নাথিং টু বি থ্যাঙ্কট ফর। নাও নাও ধরাও আরেকটা সিগারেট বলতে বলতে ফিল তার ফিলিপ মরিসের প্যাকেটটা আবারো এদিকে ঠেলে দিলে হাসতে হাসতে নিজের বেনসনের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিজের জন্য বের করে সেটিই তার দিকে ঠেলে দিয়ে এবার তুমি খাও আমার প্যাকেট থেকে; বলতে বলতে ভাবি, আজকালকার আধুনিক ম্যাট্রিক্স অরগানিজেশনে অনেক সময়ই কান্ট্রি লেভেলের নানাজনের অবস্থা দাঁড়ায়; যাকে বাংলায় বলে বারো ভাতারি অবস্থা, তা। নানানজনের নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় যেমন, তেমনি করতে হয় ইগো মাসাজও। এই স্ট্রাকচারের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা। আবার নতুন কেউ এসে এখানে সহজে ধরতে পারবে না এখানকার ডিসিশন ফ্লোয়ের গতিপ্রকৃতি। অবশ্য এ নিয়ে ভেবে তো লাভ নাই। আমি তো সিস্টেমের দাস, প্রণেতা নই। আহমেদ রাদির টিমের সাথে বসতে হবে দ্রুত। নাশাত ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান চটপটে আর প্রোএকটিভ! দেখি তার সাথে কথা বলে, যে সব ফাঁক বন্ধ করার জন্য দু মাস সময় দিয়েছিলাম, ওগুলোর মধ্যে একমাসে কোনগুলো সে ঠিক করতে পারে।

কী ব্যাপার? ভাবছো কী? চিন্তার তো কিছু নাই।”

না, মানে ঐ যে তুমি বললে একমাসে কী কী ঠিক করবো সেটার একটা মেন্টাল প্রায়োরেটাইজেশন করছি আর কী।

হা হা হা। ডোন্ট বার্ন ইয়োরসেলফ টু মাচ উইথ ওয়ান থিং। অলরেডি ইউ হ্যাভ লট ওন ইউর প্লেট। আচ্ছা তোমার কম্প এন্ড বেন তো ফাইনাল হয়ে এসেছে। হাতে পেয়েছ কী? ওহ! ওটা তো গিউসিকে দিয়েছিলাম তোমাকে দেয়ার জন্য।” না পাইনি। কখন দিয়েছো? আমাকে তোমার এখানে ডেকে আনার আগে আগেই যদি দিয়ে থাকো, তারপর সে আমার রুমে গিয়ে থাকলেতো আমাকে পাবে কী করে?

তাই তো, তাই তো। আচ্ছা দাঁড়াও ডাকি ওকে” বলেই মোবাইল গিউসিকে ডেকে, জিজ্ঞেস করলো ফিল ফের আমাকে

আচ্ছা তুমি না কোন একটা গলফ কোর্স খুঁজে বের করেছো, সেখানে তোমার টিম নিয়ে যাচ্ছো কবে যেন?”

সেই মিটিংয়ে তোমাকেও দাওয়াত করেছি কিন্তু। এই তো আর তিন না চারদিন পরেই। তুমি আসলে খুব ভাল হয়। মহসিনকে বলে রাখবো নাকি তোমাকে যাতে মনে করিয়ে দেয়?

না না। ওরে আর পেইন দিও না। এখানে যে গলফ কোর্স আছে, আগে এসেও আমি জানি না, আর তুমি ওটা বের করে ফেললে। অবশ্য আমি তো গলফার না। আই লাইকটি দ্য আইডিয়া অব দিস অফসাইট মিটিং। আসবো, পুরোদিনের জন্য না হলেও কিছু সময়ের জন্য।” এরই মধ্যে গিউসি হাতে কোম্পানির অতি পরিচিত এ ফোর সাইজের একটা খামভরা কাগজ নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে “হাই” বলতেই বলে উঠল ফিল– “দাও দাও ওটা সেলিমকে দাও। এন্ড অল ক্রেডিট গউজ টু গিউসি দ্য গ্রেট।”

নো নো সেলিম ডোন্ট বিলিভ হিম। ইটস আওয়ার বস দ্য গ্রেট, ফিল রাশ।”

কৃতিত্বের দাবিদার হওয়ার নিয়ে দুজনেরই ঠেলাঠেলি দেখে বললাম হাসতে হাসতে, ঠিক আছে তোমরা কেউ যা নিতে চাচ্ছো না সেটা আমাকেই দিয়ে দাও। আরে আমি এখানে আসাতেই না তোমরা সুযোগ পেয়েছ এই দর কষাকষির। তাই না? “একদম ঠিক” যুগল কণ্ঠের এই ঘোষণার সাথে গিউসি খামটি আমার হাতে পাচার করে দিতে দিতে বললো, “শোন এটা ঠিক মতো পড়ে, একটা কপিতে সই করে সেটা আমাকে দিও। এখন থেকে কিন্তু তোমার সৌদি এপয়েন্টম্যান্ট কোম্পানির দিক থেকে পুরোপুরি পাকা হয়ে গেল। বাকি রইলো শুধু ইকামা।”

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজনমানুষের কণ্ঠস্বর আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ