কয়েক মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই ডুবে যায় নগরের কাতালগঞ্জ ও পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা। অথচ একই সময়ে একই পরিমাণ বৃষ্টিতে শহরের জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত মুরাদপুরসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক এলাকায় পানিও জমেনি। এ চিত্র বিদায়ী বর্ষা মৌসুমের।
সমান বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতার এ ভিন্নতার কারণ ছিল হিজরা খাল। কাতালগঞ্জ ও পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয় এ হিজরা খাল দিয়ে। এটি শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৩৬ খালের একটি। মেগা প্রকল্পের ভৌত কাজ ইতোমধ্যে ৮৮ শতাংশ শেষ হলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও আর্থিক সংকটের কারণে খালটির গুরুত্বপূর্ণ অংশে কোনো উন্নয়ন কাজ শুরুই করতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ আছে আগামী জুন পর্যন্ত।
এমন পরিস্থিতিতে মিলেছে সু–খবর। সিডিএ’র দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেগা প্রকল্পের সংশোধিত উন্নয়ন প্রস্তাবনায় (আরডিপিপি) ১ হাজার ৫০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা সিডিএ’র নিজস্ব তহবিল ও সরকার থেকে ঋণ নিয়ে সিডিএ’র ব্যয় করার নির্দেশনা আছে। বিপুল এই অর্থের বিপরীতে সম্প্রতি ৬৫০ কোটি টাকা জিওবি ফান্ড বা সরকারি অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়। বাকি অর্থও জিওবি ফান্ড হিসেবে পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। তাই আর্থিক সংকট দূর হওয়ায় হিজরা খাল সংস্কারে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকল না। বরাদ্দ পাওয়া ৬৫০ কোটি টাকার পুরোটা হিজরা খাল সংস্কারে ব্যয় করা হবে। এদিকে হিজরা খাল সংস্কারে দীর্ঘদিনের জটিলতা ছিল ভূমি অধিগ্রহণ। দূর হয়েছে সে জটিলতাও। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ কমিটিও সম্প্রতি এর অনুমোদন দিয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন শীর্ষক মেগা প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকায়। পরবর্তীতে সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বর্ধিত ৩ হাজার ১২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ৫০ শতাংশ বা ১ হাজার ৫০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার। বাকি ১ হাজার ৫০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা সিডিএ’র নিজস্ব তহবিল ও সরকার থেকে ঋণ নিয়ে সিডিএ’কে খরচ করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, ৭৫৩ কোটি ১৪ লাখ সিডিএ’র নিজস্ব তহবিল এবং সমপরিমাণ অর্থ জিওবি ঋণ নিতে হবে। কিন্তু এ অর্থ খরচের সামর্থ্য নেই জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় সিডিএ। এর প্রেক্ষিতে সিডিএ’ অংশের বিপরীতে ৬৫০ কোটি টাকা জিওবি ফান্ড হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়। সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, হিজরা খালের ২ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার এলাকায় সংস্কার ও উন্নয়ন করা হবে। যা প্রবর্তক মোড় বদনা শাহ (র.) এর মাজার থেকে চাক্তাই খালের সংযোগ পর্যন্ত বিদ্যমান। সংস্কার কাজের জন্য এখানে ৩ দশমিক ৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে ঊর্ধ্বাংশ থেকে ১ দশমিক ৮ একর ও নিম্নাংশ থেকে ১ দশমিক ৬১ একর অধিগ্রহণের জন্য দুটো প্রস্তাব সিডিএ থেকে পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে। খালটির দুই পাশ থেকে ১৬০ টি স্থাপনা উচ্ছেদ করার প্রস্তাব করা আছে। যার বেশিরভাগ দালান, সেমিপাকা, নির্মাণাধীন ভবন ও বহুতল ভবন। ভূমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনা ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় হবে ৪৬৫ কোটি টাকা।
অবশ্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনী প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ আজাদীকে বলেন, জনগণকে হয়রানি করে আমরা কিছুই করবো না। আমাদের চেষ্টা যত পরিমাণ ক্ষতি কমানো যায়। উচ্ছেদ করতে হবে এমন স্থাপনার সংখ্যা ১০০ এর নিচে চলে আসবে। তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সিডিএ দেখে। এরপরও আমরা কেন্দ্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। এর প্রেক্ষিতে অনুমোদন মিলেছে। আশা করছি, সামনের শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু করা যাবে। শুরু হলে আগামী জুনের মধ্যে শেষ করা যাবে। হিজরা খালের কাজ শেষ হলে আগামী বর্ষায় এর সুফল পাওয়া যাবে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস আজাদীকে বলেন, দেড় হাজার কোটি টাকা যেটা আমাদের নিজস্ব ফান্ড ও ঋণ থেকে খরচ করতে বলা হয় তার বিপরীতে আমরা ৬৫০ কোটি টাকা জিওবি ফান্ড হিসেবে পেয়েছি। বাকি অর্থও জিওবি ফান্ড হিসেবে পাব। ইতোমধ্যে বরাদ্দ পাওয়া ৬৫০ কোটি টাকার পুরোটাই হিজরা খালের সংস্কার ও উন্নয়নে খরচ করা হবে বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, নগরের বাটালি হিলের উত্তর পাশ থেকেই খালটির উৎপত্তি। লালখান বাজার, পুলিশ লাইন, শিল্পকলা, এম. এম. আলী রোড, বাদশা মিয়া রোড, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা, কাপাসগোলা, চকবাজার, ফুলতলা হয়ে খালটি মিশেছে চাক্তাইখালের সঙ্গে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, একসময় খালটির প্রশস্ততা ছিল ৫০ ফুট। বর্তমানে অনেক জায়গায় ৫ থেকে ১০ ফুটও নেই। দুই পাড়ের অবৈধ দখলদারদের কারণেই এই পরিণতি।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানে হিজরা খালকে ড্রেনেজ এরিয়া–৫ এ অর্ন্তভুক্ত করা হয়। একই ড্রেনেজ এরিয়ায় অর্ন্তভুক্ত আছে ‘মির্জা খাল’ ও ‘বাকলিয়া খাল’ও। লালখান বাজার, ষোলশহর, মেহেদীবাগ, পাঁচলাইশসহ প্রায় ২ হাজার ১৮০ হেক্টর এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য হিজরা খালসহ অপর দুটি খালের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়।











