চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন যুগ পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আগামী ১২ অক্টোবর শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর বিরতির পর ক্যাম্পাসে এই নির্বাচন শুধু ভোটের লড়াই নয়, বরং ছাত্ররাজনীতির পুনঃউদয় হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় কিছুদিন চাকসু নিয়ে আলাপ আলোচনা হতে তেমন দেখা যায়নি। গত ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর চাকসু নির্বাচন কমিশন সংবাদ সম্মেলন এবং মতবিনিময় সভার আয়োজন করে আবার চাকসু নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। যার কারণে আবার সরগরম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে চাকসু কেন্দ্রিক রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়েছে। তারা প্যানেল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তবে দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব, শীর্ষ পদে প্রার্থীদের যোগ্যতা ও জোটবদ্ধ কৌশল রাজনৈতিক চিত্রকে আরও জটিল করে তুলছে।
বর্তমান সময়ে চাকসু নির্বাচনে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ ছাত্রদল। তবে তাদের প্যানেল গঠনের প্রক্রিয়া বর্তমানে অনিশ্চয়তায় ভরা। গত ১১ অক্টোবর চাকসু নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সেখানে তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দেয়া হয়নি এই অভিযোগ এনে সভা বয়কট করে বেরিয়ে আসে। তবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লিখিতভাবে দেওয়া সব মতামত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে।
শাখা ছাত্রদলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মেনে চলা ও সিনিয়র সদস্যদের প্রার্থীতা নিয়ে মতবিরোধ দলের ভেতর বিভাজন তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে শীর্ষ পদে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আছেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক জালাল সিদ্দিকী, সাবেক অর্থ সম্পাদক হাসান আহমেদ, আহসান হাবিব, সায়েদ, মো. রেদোয়ান জমাদিউল আউয়াল সুজাত, আইয়ুবুর রহমান তৌফিক, তৌহিদসহ আরও অনেকে। নোমানকে ঘিরে সিনিয়রিটি এবং মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতর মতবিরোধ রয়েছে যা প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে বিলম্ব সৃষ্টি করছে। তবে ইতোমধ্যে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই তাদের মূল সিদ্ধান্ত আসবে এমন আশা করেন নেতা কর্মীরা।
অন্যদিকে ছাত্রশিবির এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে সক্রিয় ও সমন্বিত পন্থা অবলম্বন করছে। তারা শুধু নিজেদের প্রার্থী নয়, বরং ২৪ এর ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় বিভিন্ন ছাত্র ও সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দাঁড় করাতে চায়। শীর্ষ তিন পদে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ আলী, সাবেক অফিস সম্পাদক ইব্রাহিম রনি এবং বর্তমান সেক্রেটারি মোহাম্মদ পারভেজের। তবে শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক সাইদ বিন হাবিব, প্রচার সম্পাদক ইসহাক ভূঁইয়াকে নিয়ে সমন্বিত প্যানেল ঘোষণা দিবে। যার মাধ্যমে তারা ভোটের সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে বলে এমনটা গুঞ্জন উঠেছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদও (বাগছাস) নির্বাচনী ময়দানে সক্রিয়। তবে তাদের মধ্যে ভেতরের বিভাজনের কারণে দুটি আলাদা প্যানেল দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এক প্যানেলের নেতৃত্বে রয়েছেন আহ্বায়ক মুনতাসির মাহমুদ, সদস্য সচিব আল মাসনূন ও কেন্দ্রীয় সহ–সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি। অন্য প্যানেলে কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান, কেন্দ্রীয় সংগঠক রশিদ দিনার নেতৃত্ব দিতে পারেন। সামাজিক সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) এর মুখপাত্র জগলুর আহমেদ এবং সদস্য সচিব আবির বিন জাবেদও শীর্ষ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তবে নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসেবে এই দুটি প্যানেল একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও জোট গঠনের আলোচনা চলছে। ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ যৌথভাবে প্যানেল গঠনের পরিকল্পনা করছে। অন্যদিকে, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল স্বাধীন প্যানেল ঘোষণা করতে পারে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ইফাজ উদ্দিন, মৈত্রীর সভাপতি জশদ জাকির এবং ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ধ্রুব বড়ুয়া আলোচনায় রয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নজরে আসছেন নারী অঙ্গনের সংগঠক সুমাইয়া শিকদার এবং জুলাই আন্দোলনে এক চোখ হারানো শুভ হোসেন।
ইতোমধ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা, খসড়া ভোটার তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ হয়েছে ১ সেপ্টেম্বর। আপত্তি গ্রহণের প্রক্রিয়া ২ থেকে ৪ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল, পরে স্থানীয় সংঘর্ষের কারণে সময় বৃদ্ধি করে ৯ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত করা হয়েছে। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে ১১ সেপ্টেম্বর। মনোনয়নপত্র বিতরণ ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর, জমা ১৫ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর, যাচাই–বাছাই ১৮ সেপ্টেম্বর, প্রাথমিক তালিকা ২১ সেপ্টেম্বর, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৩ সেপ্টেম্বর এবং আপত্তি নিষ্পত্তি ২৪ সেপ্টেম্বর। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ২৫ সেপ্টেম্বর, ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১২ অক্টোবর।












