হালিশহরের শতবর্ষী ইতিহাস : আজগর আলী চৌধুরী মসজিদ ও জমিদার বাড়ি

জুলকার নাঈন সাদমান | বুধবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১:৪৮ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের হালিশহরে দাঁড়িয়ে আছে দু’টি নিদর্শন, যেগুলো শুধু ইটপাথরের স্থাপনা নয়, বরং তিন শতাব্দীর ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী। প্রায় ২৩০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৭৯৫ সালে জমিদার আজগর আলী চৌধুরী যে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, তা আজও অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

মসজিদের আদি রূপ

মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদের গম্বুজ, খিলান ও দেয়ালের সূক্ষ্ম কারুকাজ যেন সময়কে পেছনে টেনে নিয়ে যায়। ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, কত যত্নে তৈরি হয়েছিল উপাসনার এই স্থান। প্রাচীন ইট আর চুনসুরকির দেয়ালগুলো এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে সেই আদি দিনের গন্ধ। কিন্তু এই মসজিদ শুধু নামাজের স্থানেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রায় আড়াই শতাব্দী ধরে এটি স্থানীয় মানুষের সামাজিক মিলনস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জুমার নামাজ শেষে বারান্দায় বসে চলত আলাপ, সমাধান হতো এলাকার ছোটবড় নানা বিষয়।

কবরস্থানের ইতিহাস

মসজিদের পাশে রয়েছে এক বিস্তৃত কবরস্থান। এখানে চৌধুরী বংশের বহু সদস্যের সমাধি, পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কবরও রয়েছে। ধর্ম, সমাজ আর ইতিহাস। তিনটি উপাদান এখানে এসে যেন একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। নামাজের ধ্বনি আর নীরব কবরের সারি মিলে তৈরি করেছে এক অনন্য পরিবেশ।

জমিদার বাড়ির ঐশ্বর্য

এই মসজিদের কয়েক কদম দূরেই রয়েছে আজগর আলী চৌধুরী জমিদার বাড়ি। প্রায় আড়াই শত বছর আগে এটি ছিল জমিদার পরিবারের ঐশ্বর্য আর ক্ষমতার প্রতীক। প্রাসাদের মতো এই বাড়িতে ছিল সভাসমাবেশের আয়োজন, সামাজিক আসর আর অতিথি আপ্যায়নের আভিজাত্য। স্থাপত্যে মুঘল ধাঁচের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক প্রভাবও স্পষ্ট। উঁচু জানালা, দৃষ্টিনন্দন অলংকরণ আর প্রশস্ত উঠান একসময় জমিদারী জীবনের মহিমা তুলে ধরত। তবে সময়ের নির্মম ছোঁয়ায় এখন কেবল ভগ্নপ্রায় দেয়ালই সেই গল্প শোনায়।

স্থানীয়দের স্মৃতিচারণ

স্থানীয় প্রবীণ আবদুল করিম বলেন, “আমার দাদার আমল থেকেই আমরা শুনে আসছি এই মসজিদ আর জমিদার বাড়ির গল্প। শিশুকালে এখানে খেলতাম, এখন মনে হয় প্রতিটি ইট যেন ইতিহাসের সাক্ষ্য।” একই এলাকার তরুণী রূপা আক্তার জানান, “আমরা যখন পাশ দিয়ে যাই, মনে হয় যেন পুরনো দিনের কাহিনি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বইয়ের ইতিহাস এখানে এসে জীবন্ত হয়ে যায়।”

ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ

আজ থেকে প্রায় দুই শত ত্রিশ বছর আগে নির্মিত এই দুটি স্থাপনাআজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ ও জমিদার বাড়িচট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। ভগ্নপ্রায় দেয়াল আর ধূলোয় ঢেকে যাওয়া অলংকরণ সত্ত্বেও এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শেকড় কোথায় প্রোথিত।

চট্টগ্রামের ১০ হাজার মানুষের মুখে ভিনদেশী খোট্টা ভাষা

সকালের আলো তখনও পুরোপুরি ছড়ায়নি। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ১৫ নাম্বার ঘাটে নদীর হাওয়া লাগছে গায়ে। একের পর এক যাত্রী উঠছে নৌকায়। মাঝিরা হুংকার দিয়ে ডাকছেন, কেউ মালপত্র গোছাচ্ছেন, কেউ যাত্রীকে সওয়ার করাচ্ছেন। ঠিক তখনই পাড়ে এসে ঠেকা অন্য এক মাঝি কথা কানে এল ভিন্ন সুরের-“ঘাটে পাসিন্দা নই, বিকেলের পরে আসব। তখন কাম বাড়িব “আমরার ইনকাম হালাই কম উয়াঁই।” “দাঁড় সামলাইতে গাপ মাইর গেল।”

শব্দগুলো অচেনা, কিন্তু শুনতে যেন কোথাও পরিচিত। বাংলা না, চাটগাঁইয়া নাকৌতূহল চেপে রাখা যায় না। এগিয়ে গিয়ে মাঝিদের জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা হেসে বললেন– “আমার বাপ দাদা দের মুখের ভাষা। এটা খোট্টা ভাষা”। খোট্টা : চার শতকের ভাষার উত্তরাধিকার। খোট্টা ভাষার প্রাণকেন্দ্র আনোয়ারার উত্তর বন্দর গ্রাম, স্থানীয়ভাবে খোট্টাপাড়া নামে পরিচিত। প্রায় ১০ হাজার মানুষ এখানে বসবাস করেন এবং সবাই দৈনন্দিন জীবনে খোট্টা ভাষায় কথা বলেন। চার শতক ধরে এ ভাষা টিকে আছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

গ্রামের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের নোনা হাওয়া, উত্তরে কর্ণফুলী নদী ও মেরিন একাডেমি, পূর্বে দেয়াঙ পাহাড়ভৌগোলিকভাবে ছোট এই গ্রামটি ভিন্ন ভাষী মানুষের মিলন স্থল। গ্রামের উঠানের এক কোণে বসা বৃদ্ধা আহামদ জানান, এই ভাষা আমাদের বাবা দাদাদের শিখানো। বাবা বলছে আমাদের বংশের মানুষ ভারত ছিলো তাঁদের নাম ছিলো খোট্টা। আর ভাষার নাম খোট্টাভাষা।

মোগল আমল থেকে স্থানীয়দের মতে, খোট্টাদের আদি নিবাস ভারতের বারানসি। মোগল শাসনামলে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের দমন করতে তাঁদের পাঠানো হয়েছিল চট্টগ্রামে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর জীবিকা হারিয়ে, অনিশ্চয়তার মধ্যেও তাঁরা এখানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলেন। ইতিহাস ও ভাষা গবেষক তসলিম উদ্দিন বলেন-“খোট্টারা মূলত উত্তর ভারতীয় হলেও ভাষার ভেতর মিশে গেছে ফারসি, হিন্দি, উর্দু, বাংলা ও চাটগাঁইয়া। ধীরে ধীরে তৈরি হয় আলাদা এক উপভাষা, যা এখন খোট্টা নামে পরিচিত।” গ্রাম ঘুরে দেখা যায়রাস্তায়, হাটে, দোকানে, ঘাটে সবাই খোট্টায় কথা বলছে। স্থানীয় নৌকার মাঝি রহমান বলেন-“বাইরে আমরা চাটগাঁইয়া বলি, কিন্তু গ্রামে ফিরে খোট্টায় কথা বললে ভালো লাগে। এটা আমাদের মনে শান্তি দেয়।”

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আবেদ আলী বলেন, “খোট্টা আমাদের ইতিহাস। আমরা চেষ্টা করি যেন এই ভাষা ও সংস্কৃতি টিকে থাকে। এটা শুধু কথা নয়, আমাদের আত্মপরিচয়।”

গ্রামে প্রবেশ করলে চারপাশের দৃশ্যকেও ভাষার সাথে জুড়ে দেয়া যায়। নদীর ঘাটে নৌকার ডাক, ঝুপড়ি দোকানের চায়ের কাপে ধোঁয়া, গলিপথে খেলাধুলাসবই খোট্টা ভাষার ছন্দে বাঁধা। ছোট্ট ছেলেরা খেলতে খেলতে একে অপরকে খোট্টা ভাষায় ডাকছে, বৃদ্ধরা গল্প করছেন এই ভাষাতে।

খোট্টা শুধু কথার মাধ্যম নয়, এটি জীবনের অংশ। গান, গল্প, আড্ডা, আচারসবকিছুই এই ভাষার মধ্যে মিলেমিশে এক আলাদা সংস্কৃতির পরিচয় তৈরি করেছে। ধর্ম বা সামাজিক বিভাজন থাকলেও ভাষাই সবাইকে একসাথে ধরে রেখেছে। সভ্যতার পথ ধরে অনেক ভাষা হারিয়ে গেলেও সেখানে আনোয়ারার উত্তর বন্দর গ্রাম এখনও ধরে রেখেছে চার শতকের ঐতিহ্য।

লেখক : রিপোর্টার, আজাদী অনলাইন

পূর্ববর্তী নিবন্ধবড়উঠানের দেয়াঙ পাহাড় ও কর্ণফুলীর মরিয়ম আশ্রমের হাতছানি
পরবর্তী নিবন্ধসিবিইউএফটিতে ড্রাপিং ও ইভনিং গাউনের ওপর ফ্যাশন শো