বিক্ষোভ আর সহিংসতার মধ্যে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। ফেসবুক–সহ ২৬টি সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করার জের ধরে জেন–জির বিক্ষোভের জেরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পতন হল ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউএমএল) এবং নেপালি কংগ্রেসের জোট সরকারের। পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন সেদেশের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌড়েলও। সামরিক হেলিকপ্টারে করে ওলি কাঠমান্ডু ছেড়েছেন এমন ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নেপালে কে দায়িত্ব নেবে, বা পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা এখনও অনিশ্চয়তায় ভরা। পরিস্থিতি শান্ত এবং নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনী দায়িত্বভার নেবে বলে এরইমধ্যে নেপালজুড়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। এক খবরে বলা হয়, দেশ ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করছেন ওলি। তার গন্তব্য হতে পারে দুবাই। তবে এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে কিছু জানা যায়নি।
বিক্ষোভকারীরা একের পর এক মন্ত্রী ও রাজনীতিকের বাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর শুরু করলে গতকাল দুপুর থেকে সেনাবাহিনী সব মন্ত্রী ও বড় বড় দলের শীর্ষ নেতাদের তাদের বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট থেকে হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া শুরু করে। তাদেরকে অজ্ঞাত সেনাঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে চলমান বিক্ষোভের কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা উদ্বেগে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সমস্ত বিমান বাতিল হয়ে গিয়েছে। পরে বিমানবন্দরে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা গতকাল নেপালের পার্লামেন্ট ভবন ও একাধিক রাজনীতিকের বাড়িতে ও দলীয় কার্যালয়ে আগুন দেয়। বিক্ষোভ ক্রমশ কাঠমান্ডু এবং বড় বড় শহরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছিল। রাজধানী পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘাতে এ পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে নেপালে।

কেপি শর্মা ওলির ব্যক্তিগত বাসভবনেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পর একে একে নেপালের প্রাক্তন এবং বর্তমান একাধিক মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেয় উত্তেজিত জনতা। দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পৌডেলকে তাড়া করা হয় রাস্তার মাঝে। রাস্তায় ফেলে তাকে মারধর করা হয়। উত্তেজিত জনতার হাতে মার খেয়েছেন সে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা এবং তাঁর স্ত্রী আরজু রানা দেউবা। আরজু বর্তমানে নেপাল সরকারের বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্বেও রয়েছেন। রেহাই পাননি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ এবং তার পরিবার। রাজধানী কাঠমান্ডুর ডাল্লু এলাকায় তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় বাড়িতে ছিলেন তার স্ত্রী রাজ্যলক্ষ্মী। কোনও কোনও সূত্রের দাবি, তাকে ভিতরে আটকে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে দগ্ধ অবস্থায় তাকে কীর্তিপুর বার্ন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তার মৃত্যু হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে রাজ্যলক্ষ্মীর ঝলসানো দেহের একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে তার শরীরের অধিকাংশই অস্পষ্ট। মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দহল ওরফে প্রচণ্ডের বাড়িতেও ভাঙচুর চালালেন ছাত্র–যুবরা। তিন বার নেপালের প্রধানমন্ত্রী হওয়া প্রচণ্ড বর্তমানে নেপালের বিরোধী দলনেতা। নেপালের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বহু বার জোট এবং সরকার বদল করেছেন তিনি।
সরকারি অফিসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাসহ সহিংস বিক্ষোভের মধ্যেই নেপালের পশ্চিমাঞ্চলীয় দুটি জেলায় দুটি কারাগার ভাঙার ঘটনা নিশ্চিত করেছেন দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা। দেশটির কাস্কি জেলার পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা কারাগারে প্রবেশ করলে ৭৭৩ জন বন্দী সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। এছাড়া তুলসীপুর কারাগার থেকে ১২৭ জন বন্দী পালানোর খবর জানিয়েছে, নেপালের ডাং প্রদেশের তুলসীপুরের এরিয়া পুলিশ অফিস। কোটেশ্বরে তিন পুলিশ কর্মীকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগও উঠেছে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত,নিবন্ধনহীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়ায় রুষ্ট জেন–জি বিক্ষোভকারীরা সোমবার কাঠমান্ডুর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখায়। তারা দুর্নীতি এবং ব্যবস্থার সংকট নিয়েও প্রশ্ন তোলে। বিক্ষোভ পরে সহিংসতায় রূপ নিলে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীসহ ১৯ জন প্রাণ হারান। এরপরই আন্দোলন সরকারবিরোধী রূপ নেয়। বাধ্য হয়ে সরকার সোমবার রাতে সোশাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুললেও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ মূল দাবিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন দল এমনকি ওলির মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও এই দাবিতে সংহতি জানান। নেপালি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গত বছরের জুলাইয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা ওলি। এর আগে ২০১৫–১৬, ২০১৮–২১ ও পরে ২০২১ সালে আরও একবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, দৃঢ়চেতা অবস্থান ও জাতীয়তাবাদী নীতির জন্য পরিচিত ওলি স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্থিরতা এবং কর্তৃত্ববাদী চর্চার অভিযোগ নিয়ে দায়িত্ব ছাড়লেন। যার দরুণ দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পর নেপালেও প্রবল গণবিক্ষোভে সরকার পতন ঘটল।
বিক্ষোভকারীরা পরিস্থিতিরি সুযোগ নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি, লুটপাট ও সরকারি–বেসরকারি ভবনে আগুন দিচ্ছে উল্লেখ করে একটি বিবৃতিতে নেপালের সেনাবাহিনী বলেছে, এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে ‘সেনাবাহিনী সহ সমস্ত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ সেনাবাহিনী বলেছে, ‘আমরা সকল নাগরিককে এই প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনীকে সমর্থন করার জন্য আবেদন করছি। পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার পরে আরও আপডেট জানানো হবে।’ এদিকে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য বিক্ষোভকারীদের সংলাপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশটির সেনাপ্রধান। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগডেল বলেছেন, জাতীয় ঐক্য এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।












