যারা সৌদিআরবে হজ্জ বা ওমরা করতে গমন করেন, দেখবেন মক্কা ও মদিনা শহরে রয়েছে অনেক সুগন্ধির দোকান। এসব দোকানের রয়েছে অনেক ক্রেতা। পণ্যের দাম অত্যাধিক, তবে বিক্রি হয় প্রচুর। সাধারণত আমাদের দেশের লোকজন এসব দোকানে কম যায়। এসব দোকানে গেলে সুগন্ধির গন্ধে মন প্রাণ ভালো হয়ে যায়। দোকানে ওরা এক ধরনের সুগন্ধি কাঠ জ্বালিয়ে রাখে। যার গন্ধে পুরো দোকান ও মার্কেটে একটা চমৎকার আবহ বিরাজ করে। সবচেয়ে আশ্চর্য ও গর্বের বিষয় হলো এসব দোকানের সবচেয়ে ভাল ও মানসম্পন্ন সুগন্ধি ও সুগন্ধি কাঠের সরবরাহ করা হয় আমাদের দেশ থেকে। যার প্রধান ক্রেতা হলো মধ্যপ্রাচ্যের শেখরা। উৎপাদন সীমাবদ্ধতার জন্য মান ভালো হলেও আমরা ওদের চাহিদামত সুগন্ধি সরবরাহ করতে পারি না। যদিও এই খাতে কোটি কোটি ডলার আয়ের সুযোগ রয়েছে।
শুধু সৌদিআরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও রয়েছে আতর সুগন্ধির প্রচুর চাহিদা। এসব দেশে রয়েছে আতর ও সুগন্ধির অনেকগুলো চেইনশপ। সেখানে আতর সুগন্ধির পাশাপাশি প্রসেস করা সুগন্ধি গাছও পাওয়া যায়। আগেই বলেছি সেসব চেইনশপের দামী আতর সুগন্ধি ও সুগন্ধি গাছের একটি বড় অংশ যায় বাংলাদেশ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় বাংলাদেশের আতর সুগন্ধি ও সুগন্ধি গাছের মান বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে ভালো। আর এসব পণ্যের জন্য মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর গ্রাম হলো আগর–আতরের আঁতুড়ঘর। লাভজনক হওয়ায় গত কয়েক দশকে এ ব্যবসা আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, কাঁচামালের সংকট ও রপ্তানিতে কম প্রণোদনার কারণে সুগন্ধি তরল আতরের উৎপাদন কমে গেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, এসব আগর–আতর মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ জাপান ও চীনেও রপ্তানি হয়। কিছুদিন আগে সুজানগরের আগর–আতর জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে।
সারা বছর সুজানগর গ্রামের লোকেরা ব্যস্ত থাকে আগর–আতর প্রক্রিয়াকরণের কাজে। কারো রয়েছে নিজস্ব কারখানা।কারো বাড়ির উঠান–বারান্দায় লোহার পেরেক মারা আগরগাছ ফালি করে কেটে কালো ও সাদা অংশ আলাদা করা হচ্ছে। জানা যায়, গাছে পেরেক মারা স্থানে কালো রঙের আগর জমা হয়। কারো বাড়িতে স্টিলের পাতিলে আগরকাঠ থেকে উৎপাদিত হচ্ছে তরল আতর।
ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত হলো আগর–আতর উৎপাদনের মৌসুম। এ সময়টা শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় গাছ থেকে সহজে আগর সংগ্রহ করা যায়। এখান থেকে মূলত সৌদি আরব ও কুয়েতে সুগন্ধি ও আগরকাঠ রপ্তানি করা হয়। সুজানগরে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে এ ব্যবসা। সুজানগরে রয়েছে ছোট–বড় অন্তত ৩০০ আগর–আতর ব্যবসায়ী। শুধু সুজানগর নয়, বিগত কয়েক দশক ধরে রাংগামাটি জেলায়ও চাষ হচ্ছে আগর গাছের।
জানা যায়, প্রাকৃতিকভাবে আগর গাছের কাণ্ড ও শিকড় ভেদ করে তেল আর নরম কাঠ খেতে ঢোকে এক প্রজাতির বিটল পোকা। পোকায় কাটা ক্ষত সারাতে গাছটি একজাতীয় রজন পদার্থ তৈরি করে। অনেকটা আমাদের শরীরের তৈরি হওয়া ক্ষতের ওপর যেমন কালচে লাল রঙের শক্ত আস্তরণ পড়ে, সে রকম। গাছের গায়ের সেই প্রতিরক্ষা পদার্থের দাম হলো কোটি টাকা। সারা পৃথিবীতে সুগন্ধি শিল্পের আরাধ্য বস্তু, যার চাষ হয় সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। আগর গাছের শরীরে যত বেশি পোকা আর ছত্রাকের আক্রমণ হয়, তত কালচে আর ঘন হয়ে ওঠে এর কাঠ ও তত বেশি সুগন্ধিতে ভরে ওঠে গাছের শরীর। প্রাকৃতিকভাবে এ প্রক্রিয়ায় সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ বছর। তবে বাণিজ্যিক ভাবে আগরের সুগন্ধি উৎপাদনের জন্য বাগানিরা গাছের শরীরজুড়ে পেরেক গাঁথেন। পেরেকের ক্ষতে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। এর চারপাশে তখন জমতে থাকে প্রতিরক্ষাকারী রজন পদার্থ। পেরেকের আঘাতে আঘাতে দামি হয়ে ওঠে আগরগাছ। জানা যায়, পেরেক ঢোকানো কিংবা প্রাকৃতিকভাবে রজন পদার্থ তৈরি হওয়া আগরগাছগুলো বাগান থেকে কেটে নিয়ে আসা হয়। পরে শ্রমিক দিয়ে ছোট ছোট টুকরা করে ১০ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়।এরপর আগরগাছের ভিজিয়ে রাখা টুকরাগুলো একটি বড় পাত্রে ঢুকিয়ে চুলার আগুনে সেদ্ধ করতে হয়। পাত্রের উপরের দিকের ঢাকনার একটি ছিদ্রের সাহায্যে সুগন্ধি বাষ্পীয় তরল বাইরে অপর একটি পাত্রে এসে জমা হয়। সেটিই হলো সেই দামী সুগন্ধি। পেরেক ঢুকিয়ে পাওয়া সুগন্ধি প্রতি তোলা তিন–চার হাজার টাকায় বিক্রি হলেও প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া সুগন্ধির তোলা ৬–২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সে হিসাবে এক লিটার সুগন্ধির দাম ছয় থেকে বিশ লাখ টাকার বেশি। আগর থেকে পাওয়া সুগন্ধি আতরই শুধু রপ্তানি হয় না। আগরকাঠ ও আগর গাছের বর্জ্যও রপ্তানি হয়ে থাকে। তবে দেশে কোনো কাজেই আগর–আতর ব্যবহার করা হয় না। একসময় বছরে ১৫০ কোটি টাকার আগর–আতর বিদেশে রপ্তানি হতো। গত কয়েক বছরে তা কমে ১০০ কোটি টাকার নিচে নেমে গেছে। যদিও ভালো মানের সুগন্ধি নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা।
বিশ্বে আতরের রয়েছে বিশাল বাজার। ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে সুগন্ধি বাজারের আকার ছিল প্রায় ৫০.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এবং ২০৩২ সালের মধ্যে এটি বেড়ে ৭৭.৫৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, আগর–আতর একটি শতভাগ রপ্তানিমুখী ও শ্রমঘন শিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ জড়িত। পরোক্ষভাবে এ সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। গত কয়েক বছরে শ্রমিকদের মজুরি, উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে পরিপক্ব পর্যাপ্ত আগর গাছের অভাবে সুগন্ধি উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। একসময় সরকার ও বনবিভাগ পার্বত্য অঞ্চলে আগর গাছ চাষের জন্য মানুষকে উৎসাহ দিতো। বিনা মূল্যে জমি বরাদ্দ ও গাছের চারা দিতো। গাছ রোপন ও এর পরিচর্যার জন্য সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিতো। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে সেই উৎসাহে ভাটা পড়েছে। বিশেষ করে একটি গাছ পরিপক্ব হতে ১৫–২০ বছর দীর্ঘ সময় লাগায় অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। অনেক জায়গায় ছোট ছোট আগর গাছ কেটে অন্যান্য গাছ বিশেষ করে ফলদ গাছ লাগানো হয়েছে নগদ লাভের আশায়। তাই সরকারের উচিত আগর গাছের চাষের বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। মনে রাখতে হবে, আমরা যত সুগন্ধি উৎপাদন করি না কেন বহিঃবিশ্বে তার শতভাগ রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। কারণ আর্টিফিশিয়াল পণ্যের চেয়ে প্রাকৃতিক পণ্যের প্রতি মানুষের চাহিদা ও আগ্রহ দিনকে দিন বাড়ছে। তাই ভর্তুকী দিয়ে হলেও বর্তমানে এ শিল্পে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমানো উচিত। যদিও সরকার গ্যাসের দাম আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে চা শিল্পের মত গ্যাসের একই দাম নির্ধারণ করা দরকার ও এর প্রণোদনা ৯% থেকে বাড়ানো দরকার। মনে রাখতে হবে এই সুগন্ধি শিল্পের রপ্তানির মাধ্যমে যা আয় হবে তার পুরোটাই আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে। এতে আমদানির পিছনে কোন ডলার ব্যয় করতে হবে না। শতভাগ মূল্য সংযোজিত হয়ে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্ফীত করবে। তাই এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে রক্ষা ও বৈদেশিক মূদ্রার আহরণের স্বার্থে সরকারকে সব রকমের নীতি সহায়তা দিয়ে এই শিল্পের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক।












