প্রচারেই প্রসার, এটা যে কোন পণ্যের মার্কেটিং এর তত্ত্ব। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচারণা চালায়। আধুনিক যুগে জনজীবনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়ে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া বা চ্যানেলসমূহ খুবই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি গণমাধ্যম রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা জনজীবনে প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে করপোরেট জগতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি বিজ্ঞাপন তৈরি হয় ভোক্তাকে আকৃষ্ট বা প্রভাবিত করার জন্য। কিন্তু অনেক সময় বিজ্ঞাপনগুলো এতটাই সামঞ্জস্যহীন হয় যে তা গ্রাহকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না, অথবা অতিরিক্ত সৃজনশীল হতে গিয়ে মূল বার্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। আমাদের সামাজিক অবস্থান ও বাস্তবতা আর টিভি পর্দায় বিজ্ঞাপনের যেন যোজন যোজন ফারাক, অনেকগুলো বিজ্ঞাপন বাস্তবতা বিবর্জিত আমরা এসব বিজ্ঞাপন থেকে তেমন কোনো শিক্ষাই পাই না, এমন কি এই বিজ্ঞাপনগুলো কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতার ধার ধারছে না। অনেকগুলো বিজ্ঞাপন আধুনিকতার আড়ালে কুরুচিপূর্ণ ও অপসংস্কৃতিরও প্রচার করছে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন চ্যানেলে বিজ্ঞাপনগুলো নীতি–নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে হাজার বছরের সামাজিক মূল্যবোধকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। অথচ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সমাজে খুব ভালো ভালো বার্তা দেওয়া যেতো। তবে এর মাঝেও কিছু বিজ্ঞাপন শিক্ষামূলক ও রুচিশীল যে নয় এমনও কিন্তু নয়।
বিজ্ঞাপন প্রতারণা কী? বিজ্ঞাপন প্রতারণা হলো যখন কোন বিজ্ঞাপন পণ্য বা পরিষেবার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য, সুবিধা বা কার্যকারিতা সম্পর্কে সামঞ্জস্যহীন, অসত্য বা ভুল তথ্য উপস্থাপন করে, যার ফলে গ্রাহকরা বিভ্রান্ত এবং প্রতারিত হন, পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে মিথ্যা দাবি করা, কম মানের জিনিসকে উচ্চ মানের বলে দেখানো যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমন পণ্য বিক্রি করা যার কার্যকারিতা বা মান বিজ্ঞাপনে যা দেখানো হয়েছে তার থেকে অনেক কম।
একটি রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনে সুন্দরী হওয়ার জন্য সাত দিনের চ্যালেঞ্জ দেখানো হয়েছে, একটি বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় অভিনয় করা বা ক্রিকেটের কমেন্টেটর হওয়ার জন্য গায়ের রঙ ফর্সা হওয়া প্রয়োজন, প্রশ্ন উঠে এসব ত্বক–ফর্সাকারী ক্রিমের যদি এতই গুণাগুণ থাকে, তবে পৃথিবীর সব মানুষ তাদের পণ্য ব্যবহার করে ত্বক ফর্সা হয়ে যেতো। আবার কোন বিজ্ঞাপনে দেখা যায় এনার্জি পানীয় খেয়ে ফু দিয়ে বাতি নিভানোর সাথে সাথে ঝড় শুরু হয়ে যায়, পাওয়ার নামক একটি এনার্জি পানীয় এর বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, পাওয়ার পান করার পর মডেল এক দৌড়ে টানেল পেরিয়ে দ্রুত গতির ট্রেনকেও ধরে ফেলে, অথচ সেই পানীয়ের গুনগত মান নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। একটা ফ্রিজের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, মুরগি জবাই করে ফ্রিজে রেখে দেয়া হলো, কিছু সময় পর ফ্রিজ খুললে মুরগি জীবিত বের হয়ে এলো। কোরবানির ঈদে তো ফ্রিজের বিজ্ঞাপন আরো জাঁকজমকভাবে উপস্থাপন করা হয় বিজ্ঞাপনটি এমনভাবে দেখানো হয় যেন কোরবানির গোশত গরিব– মিসকিনকে না দিয়ে বছরজুড়ে খেতে কোনো অসুবিধা নেই। বিকাশ নামক প্রতিষ্ঠানের একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় এক দাড়িওয়ালা টুপি পরিহিত একজন ব্যক্তিকে ডি.পি.এস করার বিজ্ঞাপনে মডেল করেছে যা আমাদের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। এরকম অন্তঃসারশূন্য বিজ্ঞাপন আমরা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমে অহরহ দেখছি। এভাবেই উদ্ভট বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ে আমাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী অনলাইন বিজনেস বা ই–কমার্স এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় কিন্তু বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপনের সাথে সামঞ্জস্য নয় এমন পণ্য দিয়ে গ্রাহকদের প্রতারণা করছে।
বাংলাদেশের সম্প্রচার নীতিমালায় কী আছে:
বাংলাদেশের যে সম্প্রচার নীতিমালা রয়েছে তার ৪২ এর ধারা মোতাবেক পণ্য, পণ্যের মান এবং ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ এর কথা বলা হয়েছে। ৪.২.২ উপধারা মোতাবেক বিজ্ঞাপন প্রতিযোগী পণ্যের তুলনা বা নিন্দা করা যাবে না এবং এমন কোন বর্ণনা বা দাবী প্রচার করা যাবে না যাতে জনমনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হতে পারে। ৪.২.৮ উপধারা মোতাবেক বিজ্ঞাপনে পরিবেশ গত বান্ধব নয় এমন দৃশ্য প্রচার পরিহার করতে হবে। ৪.৩.২ উপধারা মোতাবেক বাংলাদেশে সংস্কৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, শিশু–কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে এবং সংস্কৃতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এরূপ বিজ্ঞাপন প্রচার পরিহার করতে হবে। ৪.৪.২ উপধারা মোতাবেক শিশুর নৈতিক, মানষিক বা শারীরিক ক্ষতি করতে পারে এমন বিষয় বিজ্ঞাপনের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না বা স্বাভাবিক বিশ্বাস ও সরলতাকে প্রতারণাপূর্ণ চাতুর্যের সাথে কাজে লাগিয়ে কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না ৪.৪.৬ উপধারা মোতাবেক প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত বিজ্ঞাপনে নারীর অহেতুক ও দৃষ্টিকটু উপস্থাপন পরিহার করতে হবে। বাংলাদেশের সম্প্রচার নীতিমালা সহ বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক নীতিমালা আছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ, প্রয়োগের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। তাই প্রতিষ্ঠান সমূহ অবাস্তব এবং অলৌকিক সব বিজ্ঞাপন প্রচার করে অনৈতিক ব্যবসা প্রসারে লিপ্ত। বিজ্ঞাপনে একটি পণ্য দেখানো হলেও বাস্তবে গ্রাহককে ভিন্ন বা কম উন্নত মানের পণ্য সরবরাহ করে কাস্টমারদেরকে ধোঁকা দেওয়ার অপপ্রয়াস সর্বত্র।
একটি বিজ্ঞাপন যদি তার গ্রাহকের চাহিদা ও পণ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, অথবা যখন বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্ত, বার্তা বা উপস্থাপনা দর্শকের বিশ্বাস, মূল্যবোধ বা প্রয়োজনগুলোর সাথে না মেলে, তখন এটি প্রত্যাশিত প্রভাব তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। বিজ্ঞাপন ও পণ্যের বাস্তবতার মধ্যে যদি বিস্তর ফারাক থাকে তবে এটি গ্রাহকদের কাছে অপ্রীতিকর বা অবাস্তব মনে হয়। তখন গ্রাহক ঐ ব্র্যান্ডের উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে পারে এবং বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগের অপচয় হতে পারে। বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তুু এমন হওয়া উচিত বিজ্ঞাপনটি যেন নির্দিষ্ট দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং তাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়, কিন্তু বাস্তবতা বিবর্জিত এসব বিজ্ঞাপনের মোহজালে আবদ্ধ হয়, আমাদের ব্যবসায়ীদের মূল্যবোধ এখন নিম্নগামী। তাই বিভিন্ন পণ্যের গ্রাহক হিসেবে আমাদের উচিৎ বাস্তবতা বিবর্জিত বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারিত না হওয়া, বরং ঐ সব পণ্য কেনার আগে বিজ্ঞাপনে দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই করা এবং এসব পণ্য বর্জন করা। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারিত হলে আমরা নানা জুট ঝামেলার কারণে একরকম চুপ করেই থাকি, কিন্তু ভোক্তা অধিকার আইনে ভোক্তা প্রতারিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার সংস্থাগুলির সাথে যোগাযোগ করে অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও বাস্তবতা বিবর্জিত এইসব বিজ্ঞাপন প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। বিজ্ঞাপন নীতিমালা অনুসারে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো নিজস্বভাবে বিজ্ঞাপনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে পারে এবং প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে পারে, পণ্যের সঠিক তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা, এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, বিশেষ করে যখন তা সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হয় তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।












