বাংলাদেশের উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে অর্কিড অত্যন্ত নান্দনিক ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী। বিশেষত মানুষ ঘরবাড়ি, অফিস–আদালতসহ যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে সৌন্দর্যবর্ধন ও নান্দনিকতার জন্য অর্কিড সাজিয়ে রাখেন। তবে দেশের চিরহরিৎ ও সংরক্ষিত পাহাড়ি বনাঞ্চলে এখনো বুনো অর্কিড বনে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। অর্কিড ফুল হলেও এর উৎপাদন সীমিত পর্যায়ে; যে কারণে ব্যাপক চাহিদা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সংরক্ষিত বনের অর্কিডও হুমকির মুখে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার মিশ্র চিরহরিৎ বনে বুনো অর্কিড পাওয়া যায়। অর্কিড পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ হওয়ার কারণে বয়স্ক গাছের বাকলে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকে। আবার কিছু অর্কিড মাটিতেও জন্মে– সেগুলা মূলত স্থলজ অর্কিড। বাংলাদেশে প্রায় ২০০ প্রজাতির বুনো অর্কিড রয়েছে। নানা প্রতিকূলতার কারণে বুনো অর্কিডের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এর অন্যতম কারণ বনভূমির ক্রমশ হ্রাস, অপরিকল্পিত জুম চাষ, বনে পুরাতন বয়স্ক গাছের অপ্রতুলতা, ওষুধ ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বন থেকে অবৈধভাবে অর্কিড পাচার। এসব বুনো অর্কিড স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রথাগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও সংরক্ষণ করে বলে মনে করছেন বন কর্মকর্তারা।
পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং সংরক্ষিত বন, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, বিলাইছড়ির রাইক্ষ্যং সংরক্ষিত বন, বরকল উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুবলং এলাকার প্রাকৃতিক বনে এখনো প্রায়শই বুনো অর্কিড দেখা যায়। এরমধ্যে গাছে জন্মানো পরাশ্রয়ী ও মাটিতে জন্মানো স্থলজ অনেক অর্কিডের নাম বৈশিষ্ট্য অজানা। এরমধ্যে ডেন্ড্রোবিয়াম, বালবোফাইলাম, সিম্বিডিয়াম, পলিডোটা, ইউলোপিয়া, নারভিলিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতি দেখা যাচ্ছে। এদিকে, চলতি বছরই বুনো অর্কিডের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রাঙামাটি বন অঞ্চলের অধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ একটি বুনো অর্কিড সংগ্রহশালার উদ্যোগ নেয়। এই সংগ্রহশালায় পাহাড়ি সংরক্ষিত বন থেকে বুনো অর্কিড সংগ্রহ করে বুনো অর্কিডের ২০ প্রজাতির অর্কিডের অস্তিত্ব রক্ষায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া উদ্ভিদবিজ্ঞানসহ প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক শিক্ষার্থী ও গবেষকদের বুনো অর্কিড নিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
রাঙামাটি শহরের বনরূপা এলাকায় মূলত ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের তখনকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়ার সরকারি বাসভবন চত্বরে বুনো অর্কিডের সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন জাহিদুর রহমান নিজেই। বুনো অর্কিড সংগ্রহশালাকে বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা ছিল ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের। চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল রাঙামাটিতে প্রাতিষ্ঠানিক ভ্রমণে এসে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আমীর হোসাইন চৌধুরী সংগ্রহশালাটি পরিদর্শন করেন এবং এটি আরও বৃহৎ পরিসরে বৃদ্ধির দেন বলে জানান বন কর্মকর্তারা। তবে গত ৩ সেপ্টেম্বর ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ থেকে বদলিজনিত কারণে পটুয়াখালীর উপকূলীয় বন বিভাগে যোগদান করেন ডিএফও ড. জাহিদুর রহমান মিয়া। যে কারণে অর্কিড সংগ্রহশালার ভবিষ্যৎ নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
বাংলাদেশে বুনো অস্তিত্ব ও হুমকির কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়া আজাদীকে বলেন, বাংলাদেশে যত প্রজাতির অর্কিড রয়েছে, তারমধ্যে ১৩ প্রজাতির অর্কিড রক্ষিত উদ্ভিদের তালিকায় রয়েছে। এরমধ্যে ইউলোপিয়া, বালবোফাইলাম, ভেন্ডা, ডেন্ড্রোবিয়ামসহ অনেক প্রজাতি এখন আমাদের সংরক্ষিত বনেও দেখা যাচ্ছে না। এসব বুনো অর্কিড বড় বড় গাছে জন্মে থাকে এবং বিশ্বব্যাপী বুনো অর্কিডের চাহিদা বাড়ায় অবৈধ পাচারকারীরা এগুলো বাজারজাত করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রাকৃতিক বন থেকে সংগ্রহ করে থাকে। বড় বড় বৃক্ষ কমে যাওয়া ও পাচার হুমকির অন্যতম কারণ।
উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ ড. মো. জাহিদুর রহমান আরও বলেন, বিশেষ করে অর্কিডগুলো বাঁচানোর জন্য আমরা বন বিভাগ থেকে ভাবছি এবং সে লক্ষ্যে কাজ করেছি। ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ বুনো অর্কিডের একটি সংগ্রহশালা স্থাপন করে, সেখানে রক্ষিত উদ্ভিদের তালিকায় থাকা ৫–৬টি অর্কিড সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। সমপ্রতি আমি পটুয়াখালীতে যোগদান করেছি। ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগকে বুনো অর্কিড সংগ্রহশালাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে নেবে বলে আমি আশাবাদী।