স্মৃতি বিস্মৃতির আলো–আঁধারির পটভূমিতে নক্ষত্র হয়ে আছে একটি নাম! যাঁর সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো সৃজনশীল চিন্তা ও চেতনা এবং উদ্ভাবন। যিনি আমাদের নানাভাবে ঋণী করে গেছেন– যাঁর জীবনসাধনায় আসে কৃতজ্ঞতাবোধ– তিনি আমাদের প্রেরণার উৎস– তিনি মহাত্মা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার!
যাঁর জীবনী গ্রন্থ রচনায় কাজ করতে গিয়ে গবেষক সাখাওয়াত হোসেন মজনু গিয়েছিলেন– রাউজানের মোহাম্মদপুরের স্কুলে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বিএ বিটির মূল্যায়নে – ‘এই বাংলার এতো বড়ো একজন ইঞ্জিনিয়ার (আবদুল খালেক) যদি জ্ঞান বিকাশে এবং জাতি ধর্মের জন্য অর্থের মোহ ত্যাগ করে অলাভজনক সাপ্তাহিক কোহিনূর লাইব্রেরি ও দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেন তাহলে আমার মতো একজন সাধারণ শিক্ষার মানুষ শিক্ষকতা পেশায় এসে কি ভুল করেছি?’। (এখানে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আমিও এই গ্রামের। এবং মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বিটি আমার আত্মীয়)। তিনি আরও নানাভাবে মূল্যায়ন করেছেন– মূল বার্তা হচ্ছে – আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সময়ের তুলনায় একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব।
মূলত তাঁর প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ছিল আদর্শিক। সাপ্তাহিক কোহিনূর, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, কোহিনূর লাইব্রেরি।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের জন্ম ২০ জুলাই, ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আভিজাত্যপূর্ণ বংশ মর্যাদা তবে খুব একটা সচ্ছল পারিবারিক পরিবেশ না থাকলেও শৈশব– কৈশোরেই তাঁর মানবিক পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানাভাবে।
ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে অংকুরিত ও বিকশিত স্বাধীনতাচেতনা ও দেশপ্রেমের বীজ বিকশিত হতে থাকে। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে মূল্যায়ন করতে হলে উপলব্ধি করতে হবে তাঁর মানস প্রবণতা। তাঁর মানসে শ্রেষ্ঠত্ববোধের একটি দৃঢ়তাব্যঞ্জক প্রতীতি তাঁকে সেই সমকালে এক অনন্যবৈশিষ্টের অধিকারীতে পরিণত করেছিল। এটি আবার সঞ্চারিত করেছিলেন বাঙালি মুসলিম জাতীয় মানসে।
তাঁর জীবনের সামগ্রিক উদ্দেশ্যাবলীকে কয়েকটি শিরোনামে ভাগ করতে পারি–
জাতীয় জাগরণ, আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা, নারী শিক্ষার প্রসার ও ক্ষমতায়ন, সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ, দরিদ্র শ্রেণির লোকদের আর্থ–সামাজিক উন্নয়ন ও বেকারত্ব দূরীকরণ সম্ভাব্য সকল উপায়ে সামাজিক উন্নতি ও কল্যাণ সাধন।
মহাত্মা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে মূল্যায়ন করতে গেলে উপলব্ধি করতে হবে তাঁর জীবন দর্শন! যেটি প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর শৈশবকাল থেকে। তিনি ছিলেন একজন অতি মেধাবী কিন্তু কখনো কোনও প্রকার অহংকার তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। জন্মভূমি তথা গ্রামের লোকজন বা প্রতিবেশীদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা এবং খোঁজ খবর নেওয়া, শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা, গ্রামের দরিদ্র জনগণের জন্য আন্তরিকতা ও মমত্ববোধের কারণে শিক্ষাজীবন থেকেই একজন কিংবদন্তিতূল্য মহাপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন।
বন্ধুবৎসল, উদার, পরোপকারী, মিষ্টিভাষী, দানশীল, নিরহংকারী অসাধারণ ত্যাগী ও নির্লোভ, নিরহংকারী এই মানুষটি ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান কিন্তু গোঁড়ামির নামগন্ধ ও ছিল না। কোমল কঠোরের অপূর্ব সংমিশ্রণে তিনি ছিলেন একদিকে অতি পরিশ্রমী অপরদিকে অসাধারণ ধৈর্যশীল এবং তেজস্বী এক অভিজাত মেজাজের মানুষ। তাঁর জীবনের তিন ধাপ– চাকরি জীবন, ব্যবসায়িক জীবন, সাংবাদিকতার জীবন।
কেন যেন মনের ভেতরে একটা প্রশ্ন জাগে– কোন জীবনের জন্য তিনি উম্মুখ ছিলেন। একজন অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তার ওপরে ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় যার দখল– যিনি অনায়াসে হাতের মুঠোয় পুরো জীবনকে বাহ্যিক সুখের আচ্ছাদনে কাটিয়ে দিতে পারতেন এক বিলাসবহুল জীবন! তাহলে!
সুন্দর এই প্রকৃতি, ফুল পাখি, সমুদ্র সৈকত সব বিধাতাই সৃষ্টি করেছেন, প্রাকৃতিক নিয়মের অমোঘ নিয়ম তারা। কিন্তু বিদ্যমান সমাজ কাঠামোয় সুন্দর ব্যক্তি জীবনের প্রকাশ মানুষেরই স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি ও এর যথোপযুক্ত পরিণতির উপর নির্ভরশীল। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের ভেতরে এই ইচ্ছে শক্তি ছিল প্রবল। তাই তিনি উচ্চ শিক্ষিত হয়েও ছিলেন মানব প্রেমিক, দেশ প্রেমিক। শিক্ষা অর্জনের মধ্যে দিয়ে তাঁর এই আত্মোপলব্ধি ও, চৈতন্যের বিকাশ ঘটেছিল, একইসাথে অন্যদেরও বিকাশে সাহায্য করেছে। শিক্ষাকে যখন বৃহত্তর কল্যাণ, ধর্মে নিয়োগ করা হয় তখন তা থেকে একজন বিনয় নামক সহস্রদল পদ্মের উষ্মেষ ঘটে। আর এজন্যেই তিনি একজন মহাত্মা।
চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। চারদিক থেকে চাকরির প্রস্তাব এলেও সব প্রস্তাবকে নাকচ করে তিনি ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে চাকরি নেন। পদবী তড়িৎ প্রকৌশলী। চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই নিষ্ঠা, সততা, শ্রম ও মেধার সমন্বয়ে চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ উন্নয়নের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটিয়ে বিশাল সাফল্য অর্জন করেন।
কিন্তু ১৯২৯ সালের পর থেকে চাকরির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পরহিতব্রতে কাজ করার লক্ষ্যে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।
শুরু হলো তাঁর ব্যবসায়িক জীবন। প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর লাইব্রেরি ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। (চাকরিতে থাকা অবস্থায়)
লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মানুষকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। ইলেকট্রিক প্রেস; ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা করা মানে একুশ শতকের তথ্য প্রযুক্তির ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসা। এখানেই তাঁর অসাধারণ বিশেষত্ব – যা ভাবলেই এক অসাধারণ বিস্ময়ে মন যেন বলতে চায়–তাঁর বিশাল প্রতিভা ও কর্মশক্তি এবং স্বকীয়তায় তিনি যেন নিজেকে এক মহাপুরুষে পরিণত করেছিলেন।
এই কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল মহান একুশের প্রথম কবিতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর প্রথম কবিতা ‘ কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি ’– এই কবিতার পেছনেও এক বিশাল প্রেক্ষাপট আছে – যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এবং থাকবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।