‘আগামীদের আসর’ ও আমার লেখালেখি শুরুর গল্প

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম দৈনিক আজাদীর প্রথম ফিচার পাতা ‘আগামীদের আসর’ নিয়ে। লিখেছিলাম, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ১৯৬০ সালে শুরু থেকে শিশুকিশোরদের প্রতিভা বিকাশে প্রকাশ করলেন এই পাতাটি। তখন পাতাটি নিজে সম্পাদনা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর কিছুদিন পাতাটি সম্পাদনা করেন তৎকালীন পরিচালনা সম্পাদক এম এ মালেক ও তাঁর ভাগিনা লেখক ডা. আলী রেজা যৌথভাবে। এরপর ‘আগামীদের আসর’ সম্পাদনায় এলেন সাংবাদিক শিক্ষাবিদ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। যিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক এবং প্রথম সংবাদ পাঠক। দীর্ঘদিন তিনি লালন করেন এই পাতাটি। তাঁর পরে পাতাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন সাংবাদিক আতাউল হাকিম। তিনিও অনেকদিন এই পাতার পরিচর্যায় ছিলেন। এরপর পাতাটির দায়িত্বে আসেন সাংবাদিক কাজী জাফরুল ইসলাম। তিনিও সুন্দরভাবে আগামীদের আসর সম্পাদনা করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এঁদের পরে পাতাটির দায়িত্ব নেন নাট্যকার সাংবাদিক প্রদীপ দেওয়ানজী। তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে এখনো এই পাতার সম্পাদনার সঙ্গে আছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায়।

স্কুল জীবন থেকে লেখালেখি শুরু হলেও আমার প্রথম লেখা প্রকাশ ১৯৮০ সালে, যখন আমি পটিয়া সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। এই লেখাটি প্রকাশিত হয় আজাদীর ‘আগামীদের আসর’এ। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ পেলেও প্রথম লেখা প্রকাশের স্মৃতি ও অনুভূতি এখনো প্রোজ্জ্বল।

এই পরিসরে আমি আজ পাঠক সমীপে জানাতে চাই আমার লেখালেখি শুরুর ছোট্ট গল্প। আমার জন্ম গ্রামে। যে গ্রাম বললেই শৈশব লাফিয়ে ওঠে সরপুঁটির মতো, খেলা করে বুকের ভেতর। সবুজ বিল, ধান ভরা মাঠ, সবুজ ঘাসতার পাশে বয়ে চলা নদী ‘চানখালী’ হঠাৎ নেচে ওঠে স্মৃতির জানালা ধরে। আমি পৌঁছে যাই অনেক বছর আগে, ফিরে যাই ছেলেবেলায়। যেখানে ঘাসফড়িঙের পেছনে ছুটতে ছুটতে সকালকে দুপুরের দিকে পাঠিয়ে দিতাম। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছনহরা ষোড়শী বালা উচ্চ বিদ্যালয়, বিদ্যালয়ের মাঠ, কিছু সহপাঠীর মুখ এবং এক প্রিয় শিক্ষকের পবিত্র ছবি। মুহূর্তে আমি চলে যাই বিদ্যালয় আঙিনায়, যেখানে সেই প্রিয় শিক্ষক আমাকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সামনে, অন্ধকারের পরিমণ্ডল ছেড়ে আলোতে। তাঁর কথা ও পরামর্শ আলোকোজ্জ্বল হয়ে ঢুকতে থাকে আমার রক্তে, আমার শিরাউপশিরায়। আমি প্রবেশ করি স্বপ্নের ভুবনে, আমি আবিষ্কার করি স্বপ্নময় একজগৎ যেখানে আমি অন্যরকম হয়ে যাই। আমার শব্দগুলো নেচে উঠতে চায়, ঝংকারে উচ্ছ্বসিত হতে চায়, ছন্দের কারুকাজে মোহময় হতে চায়। আমি চলে যাই সেই প্রিয় শিক্ষকের কাছে, চোখ বন্ধ করলেই এখনো যার মুখ আমি দেখতে পাই, কান পাতলেই শুনতে পাই যাঁর কণ্ঠ; তিনি আমার প্রিয় মুখপ্রিয় নাম: আশা কিরণ চৌধুরী।

১৯৭৮ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আমাদের স্কুলে, ছনহরা ষোড়শী বালা উচ্চ বিদ্যালয়ে, যখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। এমন দুর্দিনে তিনি স্কুলের হাল ধরেন, যখন ভালো ভালো শিক্ষকরা অন্যত্র চলে গেছেন। অমূল্য রতন বাবু (বি.কম স্যার) কলকাতায় গিয়ে আর দেশে ফিরে আসেন নি, সেখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করেন; শিশির স্যার চলে যান তাঁর গ্রামের স্কুলে; রনজিৎ স্যার যোগ দেন আইন পেশায়। তবু আশা কিরণ স্যার অন্য যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে একাই টেনে নিয়ে যান স্কুলকে, স্কুলের ছাত্রছাত্রীকে।

প্রকৃত শিক্ষকের উৎকৃষ্ট সব গুণাবলীই বিদ্যমান আশা কিরণ চৌধুরীর মধ্যে। শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে সময় মেপে ঘড়ি ধরে কখনো তাঁর পাঠ শেষ করেছেন বলে মনে হয় না। অন্তত আমি দেখি নি।

স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর ক্লাস শেষ হয় না। সে বিষয় নিয়ে পড়াচ্ছিলেন তা শেষ করেই ক্ষান্ত। প্রতিটি ছাত্রকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বোঝানোর ক্ষেত্রে তিনি অসম্ভব শ্রম দিতেন। স্কুল ছুটির পর, যে সব ছাত্র তাঁর কাছে পড়তে আগ্রহী, তাদের পড়াতেন। তবে বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং মানবিক বিভাগের সব বিষয়েই তিনি শুধু পারদর্শী নন, সমান দক্ষতা নিয়ে পাঠদান করতেন শ্রেণি কক্ষে। আমাদের স্কুলে কোনো নির্ধারিত বিষয়ের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কখনো যদি অনুপস্থিত থাকেন, তখন ঐ শ্রেণিতে উপস্থিত হয়ে যেতেন আশা কিরণ স্যার। যেখানে যে বিষয়েই শূন্যতা, সেখানেই আশা কিরণ। এমন কি ইসলাম ধর্ম শিক্ষার ক্লাসও তিনি নিতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাঁর মতো সব বিষয়ে দক্ষপণ্ডিত শিক্ষকআমি আর দেখিনি।

আমি যখন ছন্দ কাটাকাটি করি, যখন কবিতা লেখার খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করি; তখন আমার চোখে সামনে ভেসে ওঠে সেই মুখযার চেতনাবোধে আমি মুগ্ধ থাকিযার পাণ্ডিত্যে আমি বিভোর হই এবং যাঁর কথায় আন্তরিকতার অন্যরকম ছোঁয়া পাই। আমি তাঁর সাথে ছিলাম স্কুলে, স্কুল চলাকালীন এবং স্কুল পরবর্তী সময়েও। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যায় তাঁর সাথে চলে যেতাম তাঁদের বাড়িতে, চক্রশালায়। আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে, মাঝখানে আরো দুটি গ্রাম পেরিয়ে, পথ মাড়িয়ে আমি চলে যেতাম স্যারের সঙ্গে। রাতে পড়তাম, খেতাম। তারপর ঘুম। ভোর হলেই আমাদের বাড়িতে ফিরে আসা। স্যারের বাড়িটিও ছিল একটি ছবির মতো। বাড়িটাকে ঘিরে থাকতো নানারকম গাছগাছালি। সামনে পুকুর। চুপচাপ। নীরব। সুনসান। আমি এই ছোট্ট জীবনে বহু মানুষকে দেখেছি, অনেকের সাথে পরিচিত হয়েছি, লাভ করেছি অনেক গুণবানের সান্নিধ্য। কিন্তু আশা কিরণ চৌধুরীর মতো অসাম্প্রদায়িক, স্নেহপ্রবণ, উদারচিত্তের মানুষ আমি কমই দেখেছি। আমি তাঁর এক দুর্বল ছাত্র। শ্রেণিকক্ষে, যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমি ছিলাম ৯ জনের পরে অর্থাৎ দশম। সেই আমি ছিলাম তাঁর সংস্পর্শে, বোশেখের কাঠফাটা রোদে, বরষার ঝমঝম বৃষ্টিতে, শীতের কুয়াশায়; আমি পড়তাম, তিনি পড়াতেন। সেই ঐশ্বরিক পাঠদানে আমি পোক্ত হই এবং সেই বছরেই আমি হয়ে গেলাম ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সে সময় আমার সহপাঠী বন্ধুরা এবং আমার কিছু শিক্ষক অবাক হয়ে তাকিয়েছিলকী এমন আলাদিনের চেরাগ পেলাম, যার বদৌলতে এক লাফে দশম থেকে হয়ে গেলাম প্রথম? অনেকেই সেদিন হয়তো বুঝতে পারে নিআলাদিনের কোনো চেরাগ নয়, আমার বুকের ভেতর কিরণ ঢুকিয়েছিলেন আমারই শিক্ষক আশা কিরণ। স্যারের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে আমি তাঁকে পেয়েছি মাত্র কিছু সময়। ঐ সময়ে আমি তাঁর কাছ থেকে কবিতার পাঠ নিই। শ্রেণিকক্ষে, অনিবার্য কারণে, সব বিষয়ে পাঠদানের জন্য তাঁকেই আসতে হতো। প্রতি বিষয়ে পড়ানোর সময় বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের উদ্ধৃতি টানতেন তিনি। মুখস্থ বিদ্যাকে উড়িয়ে দিয়ে বিষয়টা অনুধাবন করে নিজের মতো করে পাঠ তৈরির পরামর্শ দিতেন। ধীরে ধীরে আমি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ি। শ্রেণিকক্ষে উল্লেখিত বাণী শ্লোককবিতার পংক্তি আমি আলাদা খাতায় লিপিবদ্ধ করি।

এখনো মনে আছে কিছু পংক্তি : ‘ধরায় ধরা দিতে এলো সে নবী/ ব্যথিত মানবের হৃদয়ের ছবি’। … ‘উজান বেয়ে চলরে মাঝি, উজান বেয়ে চল/ ঐ দেখা যায় রঙিন সূর্য রঙ কত উজ্জ্বল’/ … বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের এই বাংলাদেশ/ জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যেথার নাইকো শেষ/ বাংলাদেশ’। এসব পংক্তি লিখতে লিখতে একদিন আমি নিজেকে আবিষ্কার করি কবিতার ছন্দে। ছন্দ কী জিনিস, তখন না জানলেও আমি আমার চারপাশে দেখি কবিতা আর কবিতা। সবুজ ঘাস, মরিচের ঝিরিঝিরি পাতা, লাউয়ের মাচান, ঢেউ আঁকা দিঘি, বাঁশ ঝাড়, বেতবন, শাপলা ভরা পুকুরসবকিছুতে আমি কবিতাকে পাই। পাই সুরের ছোঁয়া, পাই স্বপ্নের দেশের নিরন্তর হাতছানি। কবিতা লিখতে শুরু করি আমি, লিখে যাই, বন্ধুদের দেখাই। কেউ উৎসাহিত করে, কেউ হাসে। কেউ বাহবা দেয়, কেউ পাগলামি বলে এড়িয়ে যায়। তবে ক্লাসের ফার্স্ট বয় হওয়ার সুবাদে অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেই যে লেখালেখি শুরু, আর থামাথামি নেই। ভালো হোক আর খারাপ হোকলিখেই চলেছি। শুধু কবিতা নয়, সাহিত্যের নানা মাধ্যমে টুকটাক লেখার চেষ্টা করেছি। প্রকাশিত হয়েছে ‘কী শোভা কী ছায়া গো’, অন্ত্যমিলসমগ্র১সহ ৮৫টি গ্রন্থ। পেয়েছি পুরস্কার ও পাঠকের অকৃত্রিম ভালোবাসা। আমার এতটুকু প্রাপ্তির মূলে ছিলেন আমার প্রিয় সেই শিক্ষক, যাঁর কথা আমার অনেকগুলো গ্রন্থে আমি উল্ল্লেখ করেছি সশ্রদ্ধায়। আজ তিনি নেই, কিন্তু আমার বুকের ভেতরে তাঁর সুর বাজবে চিরদিন।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো, বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও প্রাসঙ্গিক বিষয়-আশয়
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় সাত জুয়াড়ি গ্রেপ্তার