একটি দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও প্রাসঙ্গিক বিষয়-আশয়

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

কিছুকাল পূর্বে কলিকাতায় বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক দীপ মুখোপাধ্যায় এর সাথে ট্রাম্প লাইনের উপর দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল ‘রূপসী বাংলার কবি’ বা ‘তিমির হননের কবি’ কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে। যেখানে কবি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন ঠিক সে স্থানেই দাঁড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন দীপদা। আজকে দীপদাও আমাদের মাঝে নেই। দীপদার স্মৃতি রোমন্থনের আলোকেই কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এ লেখা।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ এবং অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সত্যানন্দ দাশ, মাতা কুসুম কুমারী দাশ। পিতা বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক। ফলে ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছরের জীবনানন্দকে ভর্তি করানো হয় ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। ১৯১৫ সালে এ বিদ্যালয় হতে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ সালে কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ বি.এ পাস করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। পরীক্ষায় সময় রক্তআমাশয় জনিত রোগের কারণে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯১৯ সালে ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষ আবাহন’ নাম বিহীনভাবে ছাপানো হয়।

শিক্ষকতার পেশায় কর্মজীবনের সূচনা ও সমাপ্তি। এম.এ পাসের পর কলকাতায় কলেজের বোডিংএ থাকার প্রয়োজন হলে তিনি আইন পড়া শুরু করেন। এ সময় ১৯২২ সালে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯২৮ সালে সরস্বতী পূজা নিয়ে গোলযোগ শুরু হলে অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে তাঁকেও চাকরি হতে ছাঁটাই করা হয়।

শিক্ষকতা জীবনে বাগেরহাট প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ, দিল্লীর রামযশ কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ বলিশাল, খড়গপুর কলেজ, বড়িশা কলেজ, হাওড়া গালর্স কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর কর্মজীবন আদৌ মসৃণ ছিল না। চাকরি বা তথা সুস্থির জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে। যা তাঁর লেখনির মধ্যেই ফুটে উঠেছে। অনেক সময় একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা হলেও পুষিয়েছেন।

১৯৫৭ সালে কবির মৃত্যু তিন বছর পর আগস্ট মাসে সিগনেট প্রেস থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘রূপসী বাংলা’র শেষ প্রচ্ছদের ভূমিকায় লেখা হয়েছিল, ‘বাংলার রূপ তার প্রকৃতিতে কাব্যকাহিনী এবং ইতিহাসের ঘটনায় ধৃত হয়ে আছে। এর মধ্যে বিশেষত প্রকৃতির অংশ নিয়ে আপাততকে ঘিরে যে মহিমা মণ্ডল জীবনানন্দ দাশ সৃষ্টি করেছেন, তার তুলনা যে কোন দেশের সাহিত্যেই বিরল। রূপসী বাংলা তাঁর চিত্ররূপময় কাব্যটির মধ্যেও স্বল্প পরিজ্ঞাত একটি নতুন অধ্যায়। কেননা এর প্রতিটি কবিতা এক একটি সনেট। নিভৃতে নিজের মনে চতুদর্শপদে গ্রোমিত এই কবিতাবলিতে মৃত্যুর ছায়া পড়া সকরুণ গভীর একটি ভালোবাসার কাহিনী তিনি রচনা করে গেছেন। দেশপ্রেম নিয়েও যে উৎকৃষ্ট কাব্য হয়ে উঠেছে সেই কারণেও এই গ্রন্থ কাব্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি সম্পাদন করতে গিয়ে ভূমিকায় লিখেছেন, ‘বাঙালি কাব্য পাঠককে আর বলে দিতে হবে না ‘বনলতা সেন’ এবং ‘রূপসী বাংলা’ এই দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম। জীবনানন্দ দাশের সময় কাব্যগ্রন্থ সমূহের মধ্যে এই দুটি কাব্যগ্রন্থ বিপুলভাবে জনপ্রিয়। উত্তর রবি পর্বে যে কবি দুবোর্ধ্য বলে সর্বাধিক নিন্দিত, এই দুটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। প্রকৃত কবিতার তথা কবির এমন এক মারাত্মক আকর্ষণ আছে, যা পাঠককে বোবাঅবোধ্যর অতীত চুম্বক টানে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’ জীবনানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘রূপসী বাংলা’ মায়াবীর মতো যাদুবলে পাঠক চিত্তকে অধিকার করে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। ‘রূপসী বাংলা’ একটি কাব্যগ্রন্থ হলেও সব মিলিয়ে যেন একটি সম্পূর্ণ কবিতা, একটি চিত্র গল্প। এই কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র বাংলার প্রকৃতি। কবি জীবনানন্দের অপূর্ব শব্দচয়নে যা হয়ে উঠেছে গভীরতর অসুখ আক্রান্ত পৃথিবীর শুদ্ধতার মত। বর্তমানে আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশই সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল পঠিত।

জীবদশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও খ্যাতি অর্জন করে উঠতে পারেননি। তবে মৃত্যুর পরে তিনি আধুনিক কবিতার পথিকৃৎদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সমালোচকরা এরজন্য তাঁর প্রচার বিমূখতাকে দায়ী করেছেন। কবিকে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৫২ সালে রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৫৫ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়।

১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ তে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হয়। রোজকার মতো বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। বাড়িতে ফেরার পথে কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ‘জলখাবার ও জুয়েল হাউস এর সামনের রাস্তা পেরোতে গিয়ে কী যে হলো তাঁর। তা আজও রহস্য।

ট্রামটি অবিরাম ঘণ্টা বাজাচ্ছিল। লাভ হয়নি। ট্রাম যখন থামলো, তখন তাঁর শরীরটা ঢুকে পড়েছে ক্যাচারের ভেতর। আটকা পড়া মানুষটাকে উদ্বারের জন্য জলখাবার থেকে ছুটে আসলেন দোকানের মালিক চুনিলাল দেব। তিনিই ট্রামের ক্যাচার থেকে টেনে হিচড়ে বের করে আনেন কবিকে। ততক্ষণে তিনি অচেতন। পাঁজর, উরু, কণ্ঠের হাড় ভেঙে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ কবি প্রভাত কুমার দাস রচিত জীবনানন্দ দাশ বইয়ে পাওয়া যায়।

কবির মৃত্যুর এতো বছর পরও এ দুর্ঘটনা ও মৃত্যু নানা বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। কী হয়েছিল আসলে সে দিন? তিনি কি অন্যমনস্ক ছিলেন? নিজেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন? নাকি এটি স্রেফ দুর্ঘটনা? দুর্ঘটনা স্থান হতে উদ্ধার করে তাঁকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

ডা. ভূমেন্দ্র গুহ সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেন। কবি সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস তাঁর সুচিকিৎসার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেন তাঁর অনুরোধেই পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মূখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায় কবিকে দেখতে আসেন এবং সুচিকিৎসার নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত কবি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সকল চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফল করে ২২ অক্টোবর ১৯৯৫৪ সালে রাত ১১.৩০ মিনিটে কলকাতায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে জীবনানন্দ গবেষক ডা. ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন, ‘জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনাস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যু চিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন।

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকতায় পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররুপময়। যার ফলে ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধার তিনি ভূষিত হয়েছেন। জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক হিসেবে তিনি কবি জীবনে সফলতা পেয়েছেন। কবি নজরুলের পর একজন দুঃখী মানুষ হিসেবে কবি জীবনানন্দ দাশের কর্মময় জীবন আমাদের জন্য উদাহরণ হিসেবে বর্তমান। বর্তমান আধুনিক কবিদের মধ্যে এখনো কবি জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে জনপ্রিয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআধুনিক যুগেও গুজবে হুজুগে বিভ্রান্ত মানুষ
পরবর্তী নিবন্ধ‘আগামীদের আসর’ ও আমার লেখালেখি শুরুর গল্প