কনটেইনার পরিবহনের বৈশ্বিক তালিকায় এক ধাপ পিছিয়ে গেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বৈশ্বিক তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন অবস্থান এখন ৬৮তম। ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরের কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা হিসাব করে এ তালিকা প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক শিপিং–বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবাদমাধ্যম লয়েডস লিস্ট। গত শনিবার ‘ওয়ান হানড্রেড পোর্টস ২০২৫’ শীর্ষক বিশেষ প্রকাশনায় এ তালিকা প্রকাশ করা হয়। লয়েডস লিস্টের প্রকাশনায় চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে এই বন্দর ৩২ লাখ ৭৫ হাজার একক কনটেইনার পরিবহন করেছে। ২০২৩ সালে কনটেইনার পরিবহন হয়েছিল ৩০ লাখ ৫০ হাজার। সেই হিসাবে কনটেইনার পরিবহন ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কনটেইনার টার্মিনাল, কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও পানগাঁও নৌ টার্মিনাল মিলে এসব কনটেইনার ওঠানো–নামানো হয়েছে। এর মানে হলো, কনটেইনার পরিবহন বাড়লেও বৈশ্বিক তালিকায় পিছিয়ে গেল চট্টগ্রাম বন্দর। লয়েডস লিস্টের ক্রমতালিকা অনুযায়ী, গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৬৭তম। গত এক দশকে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান সবচেয়ে ভালো ছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর এ বন্দরের অবস্থান ছিল ৫৮তম। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কোন বন্দর কত কনটেইনার পরিবহন করল, তার তুলনা করে লয়েডস লিস্টের এই ক্রমতালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা দিয়ে বন্দরে সেবার মান বিচার করা হয় না। তবে কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা দিয়ে অঞ্চলভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারণা পাওয়া যায়। কারণ, কনটেইনারে শিল্পের কাঁচামাল ও মূল্যবান পণ্য আমদানি–রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশে শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই প্রতিবছর ১০০ বন্দরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। সমুদ্রপথে দেশের কনটেইনার পরিবহনের ৯৯ শতাংশ এই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। মোংলা বন্দর দিয়ে পরিবহন হয় ১ শতাংশ। এর মানে হলো, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহনের বিকল্প বন্দর নেই।
লয়েডস লিস্টের প্রকাশনা অনুযায়ী, শীর্ষ তালিকায় স্থান পাওয়া ১০০টি বন্দরে গত বছর ৭৪ কোটি ৩৬ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো–নামানো হয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এসব বন্দরে গড়ে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীনের সাংহাই বন্দর। গত বছর বন্দরটি দিয়ে ৫ কোটি ১৫ লাখ একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর বন্দর। সিঙ্গাপুর বন্দরে গত বছর পরিবহন হয়েছে ৪ কোটি ১১ লাখ একক কনটেইনার। সবার শেষে, অর্থাৎ ১০০তম স্থানে রয়েছে চিলির সান অন্তোনিও বন্দর। এই বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ১৮ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। নৌপথে দেশের যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, তার ৯০ শতাংশের বেশি হয় এ বন্দরের মাধ্যমে। এ বন্দর বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। কৌশলগত অবস্থান থেকে এই বন্দর ভারত, মিয়ানমার এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের কাছাকাছি। সে কারণে আঞ্চলিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ বন্দর। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ প্রবেশদ্বার এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং সেকেলে ব্যবস্থার কারণে বন্দরের ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা না হলে বাংলাদেশ অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ হারাবে। প্রতিবেশীদের তুলনায় তখন পিছিয়ে পড়তে হবে। তাঁরা বলেন, অদক্ষতা একটি বড় সমস্যা। কার্গো খালাসের জন্য জাহাজগুলোকে চট্টগ্রাম বন্দরে ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের মতো বিশ্বের শীর্ষ বন্দরগুলোতে অপেক্ষা করতে হয় মাত্র ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা। এ বিলম্বের জন্য ব্যবসার খরচ বাড়ে। রপ্তানির গতি কমে যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ হারায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। ক্ষতি পূরণ করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। বন্দরের সমস্যা পুরো অর্থনীতির ওপরই প্রভাব ফেলে। জিনিসপত্রের দাম যেমন বেড়ে যায়, তেমনি বাণিজ্য সুবিধাও হারাতে হয়। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর এখন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। বন্দরের সাফল্য বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। সংস্কারের অর্থ শুধু বন্দরের সমস্যা দূর করা নয়। এর অর্থ হলো আরও শক্তিশালী জাতি গড়ে তোলা, যারা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করবে। দুর্নীতিকে অবশ্যই নির্মূল হতে হবে। প্রযুক্তিকে জায়গা দিতে হবে। শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। আর সর্বোপরি সংযোগ ব্যবস্থার অবশ্যই উন্নতি করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে শুধু দক্ষ অপারেটর বা গভীর সমুদ্রবন্দর যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা, উন্নত সংযোগ ব্যবস্থা এবং সময়োপযোগী কাঠামোগত সংস্কার। অন্যথায় এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি ধীরে ধীরে তার কৌশলগত গুরুত্ব হারাতে বসবে।