রিকশাচালককে প্রলোভন দেখিয়ে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি হাসিল

চট্টগ্রামে এলএ শাখার টাকা আত্মসাতের চেষ্টা

হাবীবুর রহমান | মঙ্গলবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

পেশায় রিকশাচালক ৭৮ বছরের শামসুল আলম। অভাবের সংসার। এরমধ্যে কন্যা অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য দরকার প্রচুর টাকা। এগিয়ে এলেন প্রতিবেশী নিয়াজুলসহ কয়েকজন। বললেন, তুমি এতো টাকা কোথায় পাবে? আমরাই ব্যবস্থা করে দিব। এজন্য তোমাকে আদালত পাড়ায় যেতে হবে। সেখানে একটি অফিসে তোমার নাম, ঠিকানা জিজ্ঞেস করবে। সঠিকভাবে সবকিছু বলতে হবে। তারপর কিছু স্ট্যাম্প কাগজে তোমার টিপসই দিতে হবে।

নিয়াজুলদের এসব কথায় আশ্বস্ত হলেন বৃদ্ধ শামসুল। কন্যার চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের উদ্দেশ্যে তাদের কথায় তিনি রাজিও হলেন। একপর্যায়ে আদালত পাড়ায় থাকা চান্দগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে শামসুলকে নিয়ে গিয়ে টিপসই নিয়ে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হাসিল করেন নিয়াজুলরা।

জানা যায়, নগরীর চান্দগাঁওয়ের মোহরা এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য শামসুলসহ অনেকের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। উক্ত ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে সংক্রান্ত একটি নোটিশ জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে প্রদান করে হাজির হতে বলা হয়। শামসুল এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। মূলত এ সুযোগে নিয়াজুলরা ফন্দি করতে থাকেন। শামসুলদের অংশের ভূমির ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী শামসুলের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে নিয়াজুলরা কৌশলে শামসুলকে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে যান এবং পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হাসিল করে নেন। হাসিল করা উক্ত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে ক্ষতিপুরণের টাকা গ্রহণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়ও নিয়াজুলরা হাজির হয়েছেন।

এ ঘটনা রিকশা চালক শামসুল বুঝতে পারেন। প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয়টি অবগত হয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয় বরাবর একটি আপত্তি দাখিল করেন। পাশাপাশি আদালতেও একটি মামলা দায়ের করেছেন তিনি। চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে সম্প্রতি শামসুল আলম বাদী হয়ে নালিশী মামলাটি দায়ের করেন। এতে মো. নিয়াজুল করিমসহ মোট চারজনকে তিনি আসামি করেছেন। বাকী তিনজন হলেন মোহাম্মদ শাহেদ আলম, মো. আবু সাঈদ ও মো. জাহেদুল করিম।

এর আগে গত ৩১ জুলাই নিয়াজুলদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বরাবর একটি আপত্তি দাখিল করা হয়। তাতে বলা হয়, বিএস ৪৮৯ নং খতিয়ানের বিএস ২১৫৮ দাগের জায়গার মালিক ও দখলদার শামসুল আলম। ভুল তথ্য উপস্থাপন করে বল প্রয়োগের মাধ্যমে এলএ শাখা থেকে টাকা উত্তোলন করে দিবে এমন মিথ্যা আশ্বাসে প্রতারণামূলকভাবে গত ৮ জুলাই চান্দগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে গিয়ে শামসুল থেকে অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল হাসিল করে নেন নিয়াজুল করিম। আরো বলা হয়, তপশীলোক্ত দাগে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদেয় টাকা শামসুল আলম প্রাপ্ত হবেন। কোন ব্যক্তিকে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনের কোন ক্ষমতা শামসুল প্রদান করেননি। এমতাবস্থায় বিএস ২১৫৮ দাগের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রাখা আবশ্যক। তা না হলে শামসুলের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।

আদালতে করা মামলার আরজিতে বলা হয়, নিয়াজুলসহ আসামিরা ভূমিদস্যু। জালজালিয়াতি করে সম্পত্তি দখল করা তাদের নেশা ও পেশা। শামসুল ও তার দুই বোনের নামে এলএ শাখা থেকে ৬২০২০/২০২৫ নং মামলা মূলে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা উত্তোলনের জন্য প্রথমে ৪ ধারায় পরবর্তীতে ৮ ধারায় নোটিশ জারি হয়। কিন্তু বাদী এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। এ সুযোগে আসামিরা পরস্পর যোগাসাজশে বাদীর টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার ফন্দি করতে থাকে। বাদী অশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ নিয়ে আসামিরা বাদীকে বিভিন্নভাবে ফুসলাইতে থাকে। গত ৬ জুলাই আসামিরা বাদীকে ফুসলিয়ে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বলতে থাকেতুমি একজন দরিদ্র মানুষ। তোমার মেয়ে অসুস্থ। অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার দরকার। তুমি এত টাকা কোথায় পাবে? বাদী অসুস্থ মেয়ের টাকা যোগাড় করতে না পারার জন্য অক্ষেপ করতে থাকে। এই সময় আসামিরা বাদীকে বলেআমরা তোমার মেয়ের চিকিৎসার যাবতীয় খরচের টাকা পয়সার ব্যবস্থা করে দিব। এতে বাদী খুব আশ্বস্ত হয়ে পড়ে। আসামিরা বাদীকে বলেআমরা যার কাছ থেকে তোমাকে টাকার ব্যবস্থা করে দেব তা নেয়ার জন্য তোমাকে আমাদের সাথে চট্টগ্রাম শহরের আদালত পাড়ায় যেতে হবে। সেখানে একটি অফিসে তোমার নাম, ঠিকানা জিজ্ঞেস করবে। সঠিকভাবে সবকিছু বলতে হবে। তারপর কিছু স্ট্যাম্প কাগজে তোমার টিপসই দিতে হবে। এই সমস্ত কার্যাবলী তুমি করতে পারলে আমরা তোমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য টাকার ব্যবস্থা করতে পারব। আসামিদের এ ধরনের আশ্বাসে বাদী মেয়ের চিকিৎসার টাকা যোগাড়ের উদ্দেশ্যে আসামিদের কথায় রাজী হয়ে যায়।

আরজিতে আরো বলা হয়, গত ১৩ মে জেলা প্রশাসকের কার্যলয় ভূমি অধিগ্রহণ শাখা চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম মহানগর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়নে প্রশাসন কর্তৃক এলএ শাখা মামলা নং/২৩২৪ থেকে বাদীর পিতার নামে স্থাবর সম্পত্তির অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ ইং (২০১৭ সনের ২১ নং আইন) এর ৮ ধারা ৩ () উপধারা মোতাবেক একটি নোটিশ প্রদান করা হয়। আসামি নিয়াজুল ভূমি অধিগ্রহণ শাখা চট্টগ্রাম থেকে বাদীর পিতার নামে ইস্যুকৃত নোটিশ সম্পর্কে অবগত হয়ে অশিক্ষিত বাদীকে ভুল তথ্য উপস্থাপন করেন এবং গত ৮ জুলাই নিয়াজুলনহ অন্যান্য আসামিরা অশিক্ষিত বাদীকে চান্দগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে গিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে লোভলালসা দেখিয়ে বলপ্রয়োগ করে বাদী থেকে টিপসই নিয়ে অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়া অব অ্যাটর্নি হাসিল করেন। আসামি মোহাম্মদ শাহেদ আলম, মো. আবু সাঈদ ও মো. জাহেদুল করিমের সহযোগিতায় আসামি নিয়াজুল করিম আমমোক্তারনামা গ্রহিতা হন। আরজিতে আরও বলা হয়, বাদী তার মালিকানাধীন একমাত্র সহায় সম্বলের ভূমির ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন বা হস্তান্তরের জন্য কাউকে আমমোক্তার নিযুক্ত করেননি। কথিত আমমোক্তারনামার বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা পেলেও অশিক্ষিত বাদী আমমোক্তারনামা সম্পাদনের রেজিস্ট্রি করতেন না। আসামিরা বাদীকে ক্ষতিপূরণ বা পণ মূল্য কোন অর্থ প্রদান করেন নাই। বাদী জানতে পেরে আমমোক্তারনামা দলিল বাতিল করতে বললে আসামিরা তা না করে উল্টো প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বলেন যে, ‘আমমোক্তারনামা নিয়ে নিয়েছি। তুমি কিছু করতে পারবে না।’ বাদী উক্ত আমমোক্তারনামা বাতিল চেয়ে নিয়াজুল বরাবর গত ৩১ জুলাই ডাকযোগে একটি নোটিশ পাঠান বলেও আরজিতে বলা হয়।

শামসুল আলমের আইনজীবী ফোরকান মোহাম্মদ আজাদীকে বলেন, জেলা প্রশাসক বরাবর আপত্তি দাখিল করার পর ক্ষতিপূরণ প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এ বিষয়ে সামনে শুনানি রয়েছে। আশা করছি, উক্ত শুনানিতে আমার মক্কেল ন্যায় বিচার পাবেন। তিনি আরো বলেন, আমার মক্কেলের সাথে যা হয়েছে সে বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে আদালতেও একটা মামলা করা হয়েছে। মক্কেল নিজে বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। আদালত মামলাটি শিল্প পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআরও ৭ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক আজ
পরবর্তী নিবন্ধথমথমে চবি, কর্তৃপক্ষের একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত