সাম্যের কবি, জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি– এসব বিশেষণের পাশাপাশি অনিবার্যভাবে নজরুলকে আমরা প্রেমের রোমান্টিক কবি হিসাবেও শনাক্ত করতে পারি (কেউ কেউ তা করেছেনও)। বৈরী পরিবেশে কিংবা পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে তিনি বারবার ছুটে এসেছেন পূর্ববঙ্গে (অর্থাৎ বাংলাদেশে), উছলিত যৌবন–জল তরঙ্গ নিয়ে প্রেমের ডালি হাতে দাঁড়িয়েছেন পদ্মা মেঘনা যমুনা ও গোমতী পাড়ের নারীদের পাশে। নার্গিস, প্রমিলা, রাণু সোম, ফজিলাতুন্নেসা নদীমাতৃক বাংলাদেশের এসব মেয়েরা ছিল তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা।
রোমান্টিক মনের আবেগ বিহ্বলতা আর প্রেম মাধুর্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন। এখানে প্রেমময় জীবনের সার্থকতা কিংবা ব্যর্থতার অংক কষার চাইতে নার্গিস, প্রমিলা এবং অন্যান্য বঙ্গনারীদের সংস্পর্শ কবিকে কীভাবে রাতারাতি বিখ্যাত করে তুলেছিল সেই ঘটনা–পরম্পরা বিশেষ করে জানতে হবে।
২। কবির জীবননাট্য নানা ধরনের নাটকীয় আর দ্বন্দ্ব–সংঘাতে ভরপুর। তবে এসব বিচিত্র জীবন জটিলতায় তাঁর সাহিত্য বাধাপ্রাপ্ত হয়নি, বরং নিত্য নতুন সৃজনশীলতায় তা মুখরিত, আমোদিত ও রোমাঞ্চিত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে এখন আমরা কবির রোমান্টিক জীবনের ভাব বিলাসিতা নিয়ে কিছু আলোকপাত করব।
এটা সত্য যে, চুরুলিয়া থানার জামুরকি গ্রামে কবি নজরুলের বাল্য শৈশব কেটেছে দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে এবং ১৯১৭ সালে যুদ্ধে যাবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অস্থির অনিশ্চয়তা এবং হতাশা তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। যুদ্ধ থেকে ‘হাবিলদার’ পদবী নিয়ে ফিরে এলেন, উঠলেন ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে, সওগাত পত্রিকার অফিসে। ইতোমধ্যে তাঁর কিছু শিশুতোষ কবিতা (সংকল্প, লিচু চোর ইত্যাদি) স্থানীয় উঠতি সাহিত্যিকদের দৃষ্টি কেড়েছিল। কবির ওপর নজর পড়ল স্বল্পখ্যাত পুস্তক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের। খান সাহেব ফুসলিয়ে এবং উদ্দেশ্যমূলক নানা কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এলেন নিজের স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লার দৌলতপুরে এবং আসার পথে তাঁকে কয়েকদিন কান্দিরপাড়ে উকিল ইন্দ্রনাথ সেনের বাড়িতে অবস্থান করেন।
১৯২১ সালে আলী আকবর খান কবিকে দৌলতপুরে নিয়ে আসেন এবং এখানেই ভাগ্নী সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে তাঁর প্রেমময় জীবনের সূচনা ঘটে (উল্লেখ করা যায়, রোমান্টিক ভাবরসে নিমজ্জিত কবি ফুলের নামে সৈয়দার নাম রেখেছিলেন ‘নার্গিস’)।
যদিও উল্লেখযোগ্য নয়, তথাপি ধারাবাহিকতা রক্ষায় আরেকটি প্রেমের ঘটনার অবতারণা করতে হয়। যুদ্ধে যাবার আগে ‘অনামিকা’ (কল্পিত নাম) নামের একজনের সঙ্গে কবি প্রথম গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। সেই স্মৃতিচারণা তিনি করেছেন ‘ব্যথার দান’–এর উৎসর্গপত্রে– ‘মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিনুম বলে ক্ষমা করেনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।’
৩। সুকৌশলে কবির সঙ্গে ভাগ্নীকে বিয়ে দেবার যে অসৎ উদ্দেশ্য ছিল আলী আকবর খানের, শেষ পর্যন্ত তা সফল হলো না। ‘ঘরজামাই’ হিসাবে থাকার ঘৃণ্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সে বিয়ের রাতেই তিনি চলে যান কান্দিরপাড়ে। মুখোমুখি হন আশালতা ওরফে দোলনের। মুসলিম নারী নার্গিসের সঙ্গে তাঁর প্রেম ভালবাসা রূপান্তরিত হয় হিন্দু রমণী আশালতা সেনের মধ্যে। পরবর্তীকালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর মন দেয়া–নেয়া হয়েছিল। তবে গোমতী পাড়ের মেয়ে আশালতা ছাড়া আর কারও সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক টেকেনি। সমালোচকরা বলছেন, নার্গিসের সঙ্গে ব্যর্থ প্রেম কবি নজরুলকে একজন সার্থক প্রেমের কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
৪। দৌলতপুরে বিয়ের আসর থেকে চলে আসার ১৫ বছর পর নজরুল হঠাৎ একটি চিঠি পেলেন নার্গিসের। বন্ধু শৈলজানন্দের মাধ্যমে চিঠির জবাব দিয়েছিলেন এভাবে: যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই / কেন মনে রাখে তারে / ভুলে যাও তারে, ভুলে যাও একেবারে। তবে ছায়ানটের ‘চৈতী হাওয়া’ কবিতাটি নার্গিসের স্মৃতি স্মারক সংবলিত মানসিক যন্ত্রণার তীব্রতম প্রকাশ বলে অনেকে মনে করেন। এতে পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক চিত্র সুনিপুণভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রমিলার প্রতি তীব্র আকর্ষণেই কবি বারবার ছুটে এসেছেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। কলকাতা থেকে কুমিল্লায় তার আসা–যাওয়ার একটা নির্ঘন্ট আমরা খুঁজে পাই প্রমিলার কাকা উকিল ইন্দ্রনাথ সেনের ডায়েরী থেকে। নজরুলের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারে চুড়ান্ত কথাবার্তার একপর্যায়ে ইন্দ্রনাথ বাবু তাঁর ডায়েরী থেকে সবাইকে বলতে লাগলেন (তিনি এ বিয়েতে সম্মত ছিলেন না), ‘তোমাদের আদরের নজরুল কতবার যে এ বাড়িতে এসেছে– গেছে, তার হিসাব রাখ? আমি বলছি শোন– ১৯২০ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে আলী আকবর খান প্রথম তাকে এ–বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর ১৮ জুন গভীর রাতে নজরুল নিজেই এ–বাড়িতে আসে। সৈয়দার সঙ্গে বিয়ে–টিয়ের বাপারে তাঁর একটা গরমিল ছিল– যাকগে ওটা আমার দেখার বিষয় না। নজরুল এখানে তিন সপ্তাহ থাকে। এরপর ১৯২১ সালের ১০ আগস্ট আসে। সপ্তাহ খানেক থাকে। ১৯২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এসে ৪ মাস অবস্থান করে। কান্দিরপাড় থেকে সে গ্রেপ্তার হয় গত বছর অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর। খবর পেয়েছি গতকাল মানে ১৯ ডিসেম্বর সে মুক্তি পেয়েছে। আমি কোনো মতেই এমন বাউন্ডেলে ছেলের সঙ্গে আমার ভাইঝির বিয়ে বরদাশত করব না।’ তবে পরিবারের অনেকের আপত্তি সত্তেও প্রমিলার সাথে নজরুলের বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল, বিয়ে হল কলকাতায়। হুগলির মহিয়সী এবং বিদূষী নারী মিসেস মাসুমা রহমান এ বিয়েতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এজন্যে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থ কবি তাঁকে উৎসর্গ করেন। এর আগের বছর ১৯২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয় প্রেম ও প্রকৃতির মিষ্টি মধুর প্রথম সংকলন ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ, যার প্রেরণা ছিলেন প্রমিলা এবং গ্রন্থটি কবি তাঁকেই উৎসর্গ করেন।
নার্গিসের মতো প্রমিলাও ছিলেন কবি রচিত অনেক কাব্যের উৎস ভূমি। এর মধ্যে একটি ‘প্রিয়ার রূপ’, যেটি লেখা হয়েছিল ১৩২৮–এর ফাল্গুনের শেষের দিকে। আরেকটি স্মরণীয় প্রেমের কবিতা ‘পূজারিণী’ যেখানে কবি প্রিয়াদের ‘ছলনাময়ী’ বলে ভর্ৎসনা করেছেন।
৫। বিদূষী রমণী ঢাকার ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ পরিচয়, পরে প্রেমানুভূতি, হৃদয়ের স্পন্দন আমাদের কাব্যসাহিত্যে এক সাড়া–জাগানো ঘটনা হয়ে আছে। তবে এই প্রেম ব্যাকুলতা ছিল এক তরফা। ফজিলাতুন্নেসার প্রতি সব সময় ব্যাকুলচিত্ত ছিলেন কবি নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন এক বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। নজরুলের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন খুব মেপে মেপে। কবির প্রাণখোলা হাসি, নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলা, কবিতার ছন্দ নির্মাণ– এসব বিষয়কে তিনি পাগলামী মনে করতেন।
ফজিলাতুন্নেসা তখন তাঁর ছোটো বোন শফিকুন্নেসা সহ থাকতেন ৯২নং দেওয়ান বাজার রোডে। নজরুল সেই বাড়িতে মাত্র তিন দিন গিয়েছিলেন। ওই তিন দিনের পরিচয় কবির মনে কতখানি প্রবল ও গভীর অনুভূতি জাগ্রত করেছিল তার উচ্ছাসময় অভিব্যক্তি সৈয়দ আলী আশরাফ সম্পাদিত ‘প্রেমের এক অধ্যায়’ নামক এক পত্র সংকলনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ ছিল, একথা সত্য। তবে সে ভালবাসা ছিল নিখাদ, অপার্থিব। নার্গিস কিংবা প্রমিলার মতো উচ্ছ্বল ঝরণাধারার মতো নয়। ফজিলাতুন্নেসার বিলাত যাওয়া উপলক্ষে ‘সওগাত’ অফিসে যে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে নজরুল অনুপম সুন্দর এক কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।
৬। সেবার ঢাকায় উদীয়মান সংগীত শিল্পী প্রতিভা সোম ওরফে রাণু সোমের সঙ্গে কবি নজরুলের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিল্পী মা বাবার সঙ্গে তখন থাকতেন পুরোনো ঢাকার বনগ্রামে। নজরুল আকস্মিক একদিন বনগ্রামে তাদের বাসায় যান এবং রাণু সোমের সঙ্গে তাঁর কুশলাদি বিনিময় হয়। পরে কবি প্রায় নিয়মিত এ বাড়িতে আসা–যাওয়া করতেন। তিনি বাণুকে গান শেখাতেন। ওর গানের খাতায় তিনি ‘বসন্ত মুখর আজি’, ‘এলো বরষা শ্যাম সরষা’, ‘প্রিয় দরশা’ প্রভৃতি গান লিখে দিয়েছিলেন। ১৯৩৬–এর অগ্রহায়নে নজরুলের দ্বিতীয় গীতিগ্রন্থ ‘চোখের চাতক’ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হলে কবি শ্রীমতি রাণু সোমকে একটি উৎসর্গপত্র লিখে দেন। ‘নজরুলকে যেমন দেখেছি’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় প্রতিভা ওরফে রাণু সোম লিখেছেন– ‘আমি যে দেখেই নজরুল ইসলাম বলে মনে করতে পারলাম তার একটা কারণ ছিল। ঝাপসা ঝাপসা শুনেছি নজরুল নাকি ঢাকায় এসেছেন। নজরুল ইসলামের নামে তখন সারা দেশ পাগল। যার কোন সুর নেই, সে–ও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আবেগ সহকারে ‘কে বিদেশী মন উদাসী’ টানে। তাছাড়া একটা লড়াই–ফেরতা লোক তো বটে। বিপ্লবাত্মক বক্তৃতা দিয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছেন দেশ, ছেলেরা উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে’ গাইতে গাইতে জেলের ফটকে ঢুকছে, প্রেমের গান গেয়ে এদিকে আমিও রাতারাতি এত নাম কিনে ফেলেছি যে, ভক্ত সংখ্যা প্রায় অগণন।’ আর নজরুলের গান গেয়ে, নজরুলের গানের প্লাবন বইয়ে দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম ভক্তি রসের সারিতে এসে দাঁড়ান প্রতিভা সোম। বিদ্রোহী কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যেও আমরা শুনতে পাই প্রেমের শ্বাশ্বত বাণী–
আমি বন্ধন–হারা কুমারীর বেণী, তন্বি নয়নে বহ্নি
আমি ষোড়শীর হৃদি–সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি।
কুমারী মনের চঞ্চলতা, উছলিত প্রাণের জোয়ার তাঁর কাব্যছন্দে অনুরণিত হয়েছে চিরন্তন প্রেমের ধারায়। নার্গিস, প্রমিলা, ফজিলাতুন্নেসা, রাণু সোম এবং অনামিকা নামের মেয়েগুলো সৌন্দর্যের প্রতিমা হয়ে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন চিরকালীন প্রেমের সরোবরে। সবশেষে মনে পড়ল পূজারিণী কবিতার কয়েকটি চরণ– ‘অমর হইয়া আছে– রবে চিরদিন / তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী নীলকণ্ঠ কবি’।
বাস্তবিকই তিনি একজন মৃত্যুঞ্জয়ী নীলকণ্ঠ কবি। নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রেমের উপাখ্যান অনেকের কাছে অযৌক্তিক, অসংগত মনে হতে পারে। তবে এটাও বলে রাখি– প্রেমও একরকম মৃত্যু। মৃত্যুর উৎসবে বরের বেশে সজ্জিত হওয়ার কথা বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি নজরুলও বলেছেন– ‘সাজিয়াছি এক মৃত্যুর উৎসবে’ কবিতায়।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক; নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত যাত্রাশিল্পী