প্রবাহ

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি : যাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান মসনবী শরীফ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৭ আগস্ট, ২০২৫ at ৪:৫৫ পূর্বাহ্ণ

তুরস্কের কোনিয়াতে শায়িত রয়েছেন হযরত মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.)। ৬ রবিউল আউয়াল ৬০৪ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বের বুকে তাসাউফ জগতে সুফি তত্ত্বে তিনি অন্যতম পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সর্বমহলে সর্ব আকিদার নিকট তিনি শ্রদ্ধাভাজন। তাঁর রচিত অনেক বিখ্যাত অতুলনীয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে মসনবী শরীফ অন্যতম। মরহুম সৈয়দ আহমদুল হক মাওলানা রুমি রচিত মসনবী শরীফের উপর দৈনিক আজাদীতে অনেক প্রবন্ধ লিখে গেছেন। মূলত মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি খোরাসানে বলখের অধিবাসী। মাওলানা রুমি ছিলেন কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক ধর্মীয় বিজ্ঞজন। কিন্তু শামস তাবরিজির সংস্পর্শে তাঁর মনমানসিকতা তথা জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এ নিয়ে রয়েছে একাধিক বর্ণনা।

মাওলানা রুমির পিতা পারস্যের বলখের অধিবাসী। বলখ বর্তমান আফগানিস্তানের আওতাভুক্ত হলেও পারস্যের খোরাসান প্রদেশের অংশবিশেষ ছিল। মাওলানা রুমির পিতা মাওলানা বাহা উদ্দিন ও পিতামহ মাওলানা হোসেন বলখী ২ জনেই প্রখ্যাত আলেম ও সাধক ছিলেন। মাওলানার পিতা খোরাসানের তৎকালীন শাসনকর্তার সাথে মত বিরোধের কারণে সপরিবারে বলখ ত্যাগ করেন। নিশাপুর বাগদাদ হেজাজসহ অনেক জনপদ সফর করেন। অবশেষে আজকের তুরস্কের কোনিয়া অঞ্চলে সুলতান কায়কোবাদের আনুকূল্যে অবস্থান নেন। তৎকালীন রোম তথা এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত এই এলাকা। আজকের কোনিয়াতে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে মাওলানা জালাল উদ্দিন পরবর্তীতে নয়া আবাসস্থলের নামানুসারে নিজের নামের শেষে রুমি শব্দ ধারণ করেন। এখানকার সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ তাঁর মুরিদ হন এবং তাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন।

পিতার ইন্তেকাল পরবর্তী পিতার যোগ্যতম মুরিদ হযরত বোরহান উদ্দিন মুহাক্কেকীর নিকট উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীতে দামেস্ক এবং আলেপ্পু বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও জ্ঞান লাভ করেন। কোনিয়াতে বসে অধ্যাপনা, গ্রন্থ রচনা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন ছিলেন। তখন হতে সেই অঞ্চলে একজন প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার হিসেবে প্রকাশ পেতে থাকেন। শরীয়ত এর জটিল বিধানের ব্যাখ্যা এবং সাহিত্য দর্শনের দুরূহ ও সুক্ষ্ম মীমাংসায় মাওলানা রুমির মতামত অভ্রান্ত হিসেবে সকলের কাছে সমাদ্রিত হয়। মাওলানা রুমি প্রথম জীবনে পাক্কা শরীয়তপন্থী ছিলেন। কাজেই ধর্মীয় নিত্য সংগীত প্রভৃতির প্রতি বিরূপ ছিলেন। কিন্তু তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষাগুরু শামস তাবরিজির সংস্পর্শে আসার পর তাঁর জীবনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে এই গোঁড়া শরীয়তপন্থী মাওলানা রুমি ছেমা তথা ধর্মীয় নিত্য সংগীতের একান্ত অনুরাগী হয়ে পড়েন। সাথে সাথে প্রখ্যাত কবি হিসেবে প্রসিদ্ধী লাভ করেন। শুধু তাই নয়, মৌলভী নামীয় ছেমা সুফি সম্প্রদায় তারই হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়।

আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভের পূর্বে মাওলানা রুমি ও পীর শামস তাবরিজির ঐতিহাসিক মিলন কাহিনী বড়ই চমকপ্রদ। মাওলানা রুমির রচনাবলীর মধ্যে ‘দিওয়ানে শামস তাবরিজি, মসনবী ও রুবায়েত নামক কাব্যগ্রন্থ এবং ফিমাফি পত্রাবলীতে মাওলানা রুমি ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক সমস্যামূলক বিষয়ে যুক্তিগর্ব আলোচনা করেছেন। দিওয়ানে শামস তাবরিজিতে প্রায় ২ হাজার ৫ শত গজল রয়েছে। মাওলানা রুমির রুবায়েতের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজার। এগুলো আধ্যাত্মিক ভাবধারায় সমৃদ্ধ।

মাওলানা রুমির শ্রেষ্ঠ অবদান মসনবী শরীফ। এটি ৬ খণ্ডে ২৫৩০ হাজার শ্লোকে পঠিত। কথিত আছে প্রায় ৪৩ বছর ধরে তিনি এই কাব্য রচনা করেছেন। শেষের দিকে কখনও কখনও সারা রাতই তিনি মসনবী রচনায় মগ্ন থাকতেন।

মাওলানা রুমির শরীরে তুর্কি রক্তের সংমিশ্রণ থাকলেও এবং জীবনের পরবর্তীকাল প্রায় ৫০ বছর খাস তুরস্কের কোনিয়াতে অতিবাহিত করলেও তিনি তাঁর রচনাবলীতে একটিও তুর্কি শব্দ ব্যবহার করেননি। বিশ্বখ্যাত এই মহান আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ ৫ জমাদিউস সানি ৬৭০ হিজরি ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩ সাল রবিবার সূর্যাস্তের সময় কোনিয়াতে ইন্তেকাল করেন।

যেয়ারত: পরপর ৩ বার তুরস্ক সফরকালে প্রতিবারই ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় ৭ শ’ কি.মি দূরত্বে কোনিয়া যাওয়া হয় আল্লামা রুমির যেয়ারতে। প্রথমবার ২০০৮ সালে ইরান সফর করার পর তেহরান থেকে টার্কিশ এয়ারে ইস্তাম্বুল পৌঁছা হয়। হজ ওমরাহ যেয়ারতের পর মুসলমানগণের জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে ইস্তাম্বুল গমন করা আবশ্যক বলে মনে করি। এমনিতেই বলে থাকি মুসলমান নারীপুরুষের সুন্দর জীবনযাত্রা এবং তাদের বিলাসিতাবিহীন অতীব পরিচ্ছন্ন কর্মতৎপর জীবন প্রত্যক্ষ করতে প্রথমে ইরান অতঃপর তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়া সফর করা আবশ্যক বলে মনে করি।

সফরে সহযাত্রীর আগ্রহে বাসে আঙ্কারা হয়ে কোনিয়া রওনা হই। ইস্তাম্বুলআঙ্কারা প্রায় ৪৫০ কি.মি মহাসড়ক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ বলা চলে। বিকেলে কোনিয়া পৌঁছলে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে আমাদের ২ রাত থাকা হয়।

মূলত কোনিয়া কেন্দ্রিক ৯ হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। ইহা বিশ্বের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। অবাক করা ব্যাপার সমস্ত তুরস্কবাসী মাওলানা রুমিকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করে।

২য় বার যেয়ারতে যাওয়া হয় ইস্তাম্বুল থেকে আকাশপথে। ঐ সময় তুরস্কের অনারারি কনসাল জেনারেল সালাহউদ্দিন কাশেম খানের আগ্রহে অতিথি হয়ে তুরস্কে যাওয়া হয় ২০১১ সালে। এই সময় আমরা বিকেলের ফ্লাইটে গিয়ে পরদিন সন্ধ্যার ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল ফিরে আসি। ৩য় বার তথা ২০২৩ সালে আগস্টে ঢাকা থেকে সরাসরি ইস্তাম্বুল যাওয়া হয়। ৬ দিন ইস্তাম্বুলে অবস্থানের পর সকালের ট্রেনে কোনিয়া যাওয়া হয়। তুরস্কের ট্রেনগুলো বুলেট ট্রেন না হলেও হাইস্পিড ট্রেন হিসেবে অতীব আরামদায়ক। ঘণ্টায় ২৫০ কি.মি পর্যন্ত গতি তুলা হয়। এখান থেকে আমরা পরদিন বিকেলে আঙ্কারা আসি। আঙ্কারা ২ রাত অবস্থানের পর ইস্তাম্বুল হয়ে ১৩ দিনের প্রোগ্রামে মিশরে যাওয়া হয়।

কোনিয়া প্রায় ৯ হাজার ৫ শ’ বছরের পুরানো শহর তথা বিশ্বের প্রাচীন জনপদ হলেও প্রায় হাজার বছর ধরে মাওলানা রুমির কারণে কোনিয়া গর্বিত বলা যায়। প্রায় আধা বর্গ কি.মি এরিয়া নিয়ে বিশাল মাজার কমপ্লেক্স। ২০২৩ সালে প্রত্যক্ষ করলাম যেয়ারতের জন্য টিকেট সিস্টেমটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। যা যথাযথ সিদ্ধান্ত। প্রায় ৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত তার ধর্মীয় কমপ্লেক্স যা বর্তমান প্রকান্ড মাজার কমপ্লেক্স ৩ বার কোনিয়া গমনকালে এক বা একাধিক বার মাজারের অভ্যন্তরে প্রত্যক্ষ করে বুঝতে পারি এখানে একটি ছোট মসজিদ ও একটি ছেমা মাহফিলখানা রয়েছে। ছোট মসজিদের বারান্দার দিকে তথা কেবলার বিপরীত দিকে ছেমা মাহফিলখানা ছিল। মনে হয় মসজিদে নামাজ এবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি মসজিদের অভ্যন্তরে ছেমা মাহফিল না করে বারান্দায় গিয়ে তিনি ছেমা মাহফিল করতেন। আরও দৃষ্টি দিলে বুঝা যাবে, মাওলানা রুমি ও তাঁর পিতার কবর মসজিদের বাহিরে কেবলার দিকে। মাওলানা রুমি ও তাঁর পিতার কবর পৃথক পৃথক গিলাফ দিয়ে আবৃত করা। মাথার দিকে পৃথক পৃথক রুমি পাগড়ী বসানো রয়েছে। সেই সময়কার এই মসজিদের তথা কেবলার দিকে এবং বামপাশে আরও ২০/৩০ টি কবর রয়েছে। প্রত্যেক কবর গিলাফ দ্বারা ঢাকানো। তেমনি প্রত্যেক কবরে মাথার দিকে রুমি পাগড়ী বসানো রয়েছে। এখানেসহ তুরস্কের প্রায় সমস্ত কবর মাথার দিকে উঁচু নিচের দিকে ঢালু। বর্তমান মাজারের অভ্যন্তরে সেই সময়কার মসজিদটিতে ৭০৮০ জন লোক একত্রে নামাজ পড়তে পারে। এই মাজারের বাহিরে আরও ছোট ছোট কয়েকজন সুফি দরবেশের মাজার রয়েছে। ৭০/৮০ মিটার দূরত্বে বাগানবেষ্টিত প্রকান্ড জামে মসজিদ। ১৫৬৭৭৪ সালে নির্মিত এই মসজিদে ৩/৪ শ’ লোক নামাজ পড়তে পারে।

এখান থেকে প্রায় ৪/৫ শ’ মিটার দূরত্বে হযরত শামস তাবরিজির মাজার। কয়েক কি.মি দূরত্বে হযরত সদরুদ্দিন পৌনবীর মাজার। কয়েক শত মিটার দূরত্বে এখানকার বাদশাহ আলাউদ্দিন কায়কোবাদের মসজিদ সমাধি যাবতীয় কিছু সমতল ভূমি থেকে কিছুটা উচ্চতায় পাহাড়ের উপর। মৌলিকভাবে তুর্কিদের কাছে ইস্তাম্বুলের পর ধর্মীয় দৃষ্টিতে কোনিয়ার অবস্থান।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেন্ট মেরীস স্কুলে একটি ত্রিপলের অভাবে শিক্ষার্থীদের কষ্ট
পরবর্তী নিবন্ধপ্রেমের সরোবরে নীলকণ্ঠ এক কবি