মিয়ানমারে গণহত্যার ৮ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে কক্সবাজারের উখিয়া–টেকনাফের ক্যাম্পে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা’ দিবস পালন করেছে নিজ দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত ও নিপীড়নে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। গতকাল সোমবার সকালে উখিয়ার মধুরছড়া ক্যাম্পের ফুটবল মাঠে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গা অংশ নেন। এছাড়া পথসভা ও মিছিল করেন তারা।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ও রাখাইন গোষ্ঠীর নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট জন্মভিটা ছেড়ে পালিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর ২৫ আগস্ট দিনটি রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। গতকালের সমাবেশে রোহিঙ্গারা রাখাইনে তাদের বাপ–দাদার ভিটেমাটিতে ফেরার আকুতি তুলে ধরে আট বছর আগে তাদের ওপর চালানো বর্বর ‘গণহত্যার’ বিচারের দাবি জানান।
জানা গেছে, অতীতের মতো অষ্টম বর্ষ পালনে গতকাল সকাল ৭টা থেকে উখিয়া–টেকনাফের অন্তত ১৫টি ক্যাম্পে মানববন্ধন, পথসভা ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উখিয়ার মধুরছড়া ক্যাম্পের (ক্যাম্প–৪) ফুটবল মাঠে আয়োজন করা হয় সমাবেশের। এতে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ জড়ো হন।
ক্যাম্প–৯ এর ডি ব্লক, সাব–ব্লক সি–৬ এর বলিবাজার মাঠে সকালে মাস্টার সাদেক ও আরএসও নেতা মৌলভী মোহাম্মদ নূরের নেতৃত্বে কর্মসূচি উদ্বোধন করেন মুফতি আনিস। এতে হেডমাঝি আবদুল আমিন, রোহিঙ্গা নেতা ডা. জুবায়ের, রহমত উল্লাহ, সাদেক হোসেন, আহমেদ, ইউসুফ, হেলাল (কায়ু মাইং), মৌলভী বনি আমিন, নজিমুল্লাহ, মুফতি আনিস, মৌলভী সাদেক, ক্যাম্প–৯ এর শমসু নূর এবং ক্যাম্প–১১ এর আরএসও সদস্য সায়েদুল আমিনসহ প্রভাবশালী নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে বক্তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
ইনানী সৈকত এলাকার বে–ওয়াচ হোটেলে চলমান রোহিঙ্গা সংলাপ নিয়ে দ্বিতীয় দিবসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগমন উপলক্ষে সকাল ১০টার দিকে দ্রুত সমাবেশ শেষ করা হয়। সমাবেশস্থলে দেখা যায়, নানা দাবি সম্বলিত ফিতা মাথায় বেঁধে ও হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে সমাবেশে জড়ো হন রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ। কিছুক্ষণ পরপর মিছিল করে সমাবেশে নানা বয়সী মানুষকে জড়ো হতে দেখা যায়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়া স্বজনদের ছবিও নিয়ে আসেন অনেকে। প্ল্যাকার্ডগুলোতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধানের বিচার দাবি করা হয়। এতে বক্তব্য রাখেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মোহাম্মদ জুবাইর, রোহিঙ্গা নেতা হোসেন ইব্রাহিমসহ বিভিন্ন স্তরের কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ।
বক্তারা বলেন, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ইতিহাসে এক কলঙ্কিত, ভয়াবহ এবং হৃদয়বিদারক দিন। এটি শুধু একটি তারিখ নয়, একটি বেদনাবিধুর স্মৃতি। আমাদের হাজারও সন্তান নৃশংস খুনের শিকার হয়েছে, অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, গৃহহীন হয়েছে লাখো পরিবার। আমরা এ দিনটিকে স্মরণ করি রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসেবে। শোকের এ দিনে শুধু কান্না নয়, বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মিজানুর রহমান বলেন, গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। রোহিঙ্গারা টেকসই, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি আইসিজে (আন্তর্জাতিক বিচার আদালত) এবং আইসিসিতে (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) যে বিচারকাজ চলমান, তার নিষ্পত্তি কামনা করেছেন।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। এর মধ্যে এক লাখ ২৪ হাজার এসেছে গত ১৮ মাসে। নিবন্ধিতদের বাইরে অনেক রোহিঙ্গা রয়েছেন। কিন্তু গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।