কেবল চলচ্চিত্র নয়, যে কোনো প্রকাশ মাধ্যমে ন্যারেটিভিটির ব্যাপারটি পরিলক্ষিত হয়। তবে এর প্রয়োগে স্বভাবতই পার্থক্য বিদ্যমান। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ন্যারেটিভিটির প্রয়োগ দেশ ভেদে ও নির্মাতা ভেদে ভিন্নরকম। এক্ষেত্রে বিশেষ কিছু ঘরানা বা স্কুলিংও রয়েছে যার মধ্যে ফরাসি চলচ্চিত্র অন্যতম। এই ফরাসি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ঘরানার ন্যারেটিভিটির প্রভূতি প্রভাব ইরানের বিভিন্ন চলচ্চিত্রকারের মধ্যে লক্ষণীয়। এমন কি ইরানের মূলধারার ছবিতেও ফরাসি এই প্রভাব দেখা যায়। ইরানের অনেক নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক প্রশিক্ষণ কিংবা পড়াশোনা করেছেন ফ্রান্সের বিভিন্ন চলিচ্চত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অনেকে মূলত সে দেশে বসবাস করেন। স্বভাবতই এর একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে ইরানের সিনেমায়।
এই অবতরনিকার নেপথ্যে রয়েছে ২০২৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানের নন্দিত চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহি যিনি স্বেেদশে দীর্ঘদিন যাবৎ নির্যাতিত, তাঁর সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘ইট ওয়জ জাস্ট এ্যান এ্যাক্সিডেন্ট’–এর পাম দ্য অর বা গোল্ডেন পাম বিজয়। এই পুরস্কারটি বিশ্বচলচ্চিত্রে রীতিমতো একটি শ্লাঘার স্মারক। মর্যাদা ও আভিজাত্যের বিচারে এ পুরস্কার অস্কারের চাইতে দামি বললে অত্যুক্তি হয় না। জাফর পানাহির ছবি এর আগেও কানে পুরস্কৃত হয়েছে। তবে ফরাসি ঘরানার পরিচালক ও ইরানের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের বীতরাগের কারণে জেদবশত পানাহির ভাগ্যে এসব পুরস্কার জুটেছে বললে অন্যায় করা হবে। তাঁর সাহস, প্রতিবাদ, তাঁর প্রতি নির্যাতন, প্রতিবন্ধকতা এসবকে তিনি জীবন সংশয় করে যেভাবে ক্রমাগত তাঁর চলিচ্চত্রে তুলে ধরে চলেছেন, এসব পুরস্কার তারই স্বীকৃতি।
জাফর পানাহির চলচ্চিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য, সহজ সরলভাবে একটি গল্প বা আখ্যানের বর্ণনা, কিন্তু সে গল্পের বুননে উঠে আসে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানান প্রতিবন্ধকতা, ন্যায়হীনতা, প্রপঞ্চকতা, অমানবিকতার চিত্র, যা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র নির্দেশিত সমাজ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ব্যতিব্যস্ত করে, যার ফলে রাষ্ট্র ও বিশেষ একটি সমাজ তাঁর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এর ফলে তাঁকে মুখোমুখি হতে হয় নিপীড়ন–নির্যাতনের।
ইরান অনেক দিন ধরে চলচ্চিত্র শিল্পে অগ্রবর্তী। শিল্পসমৃদ্ধ ধারা তো বটেই, এদেশের মূলধারার বাণিজ্যমনস্ক চলচ্চিত্রেরও একটি উন্নতমান বিদ্যমান। কিন্তু প্রায় শুরু থেকেই এদেশে দমন পীড়নের একটি ইতিহাস লক্ষণীয় চলচ্চিত্রকে ঘিরে। রাজকীয় যুগে যেমন স্বাধীন চিন্তা চেতনার প্রকাশকে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং কখনও কঠিন শাস্তি প্রদান করে দমিয়ে রাখার চল ছিল, ইসলামী শাসন ব্যবস্থার যুগেও সেই একই প্রবণতা, সেই একই চল অব্যাহত রয়ে যায়। কেবল তা নয় এই প্রবণতা আরও কঠিন, আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। কঠোর সেন্সরশিপ প্রবর্তিত হয়। বিশ্বে একমাত্র ইরানে ছবি নির্মাণের পূর্বে ছবির চিত্রনাট্য সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে হয়। বোর্ড চিত্রনাট্য ছাড় দিলে তবে ছবি নির্মাণ করা যায়। ছবি তৈরির পর সেটি আবার জমা দিতে হয় সেন্সর বোর্ডে। তারপর প্রদর্শনের চূড়ান্ত ছাড়পত্র মেলে। জমা দেয়া চিত্রনাট্য কাটাছেঁড়া অবস্থায় ফেরত পাবার পর সেই খোঁড়া চিত্রনাট্য দিয়ে ছবি বানিয়ে মোহসেন মখমলবাফ, আব্বাস কিয়ারোস্তমি, মজিদ মাজিদি, বাহরাম বেহজাই, আসগর ফরহাদি, তাহমিনেহ মিলানি, নাসের তাগবাই কামরান শিরদেল, জাফর পানাহিরা বিশ্বজয় করেন। কিন্তু স্বদেশে থাকেন উপেক্ষিত ও সন্দেহভাজন। বিশেষ করে শেষোক্ত জন।
জাফর পানাহি শুরু থেকেই ইরানের কট্টরপন্থী সরকারের নানান অমানবিক নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন নিজের মাধ্যমের প্রকাশের মধ্য দিয়ে। কখনো সরাসরি, কখনো রূপকাশ্রয়ে। ফলে প্রথম থেকেই তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল প্রশাসন। ছবি আটকে রাখা, বিদেশের বিভিন্ন উৎসবে যোগদানে অনুমতি না দেয়া, জীবন যাপনে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার মধ্য দিয়ে জাফরকে রীতিমতো অতিষ্ঠ করে তোলা হয়। ইচ্ছে করলে তিনি বিদেশে স্থিত হয়ে নির্বিঘ্নে সিনেমা বানাতে পারতেন তাঁর অনেক সতীর্থদের অনুসরণে, যাঁরা মূলত প্যারিসে চলে গিয়ে এ কাজ করছিলেন। কিন্তু জাফর মাতৃভূমির মাটি আঁকড়ে পড়েছিলেন এবং নির্মাণ করে চলেছিলেন একের পর এক চলচ্চিত্র। কারণ তিনি মনে করেন, ইরানের সাধারণ জনগণ তাঁর সঙ্গে আছেন সবসময়, তাই তিনি নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না, এদেশ ছাড়া আর কোথাও তিনি নিজেকে খুঁজে পান না, একটাই মাটি তাঁর, একটাই ভাষা, একটাই সংস্কৃতি। ইরানের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি যতই ঘৃণা, অবজ্ঞা দ্বেষ থাকুক, তাদের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে যতই প্রতিবাদ থাকুক, ইরানের সাধারণ জনগণের বিবেক, সুবুদ্ধি আর ভালোবাসার প্রতি তিনি সর্বদা আস্থাশীল। তারা যেভাবে প্রতিনিয়ত নিগ্রহের শিকার হন, সে সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–প্রতিরোধ করতে হলে, তাঁকে ইরানের মাটিতেই থাকতে হবে নিজের জীবনের সংশয়কে উপেক্ষা করে। ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজকাঠামোয় বর্তমানে নারীদের প্রতি যে অবরোধমূলক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জারি রয়েছে সেটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় জাফর পানাহির ‘দ্য সার্কল’ ও ‘অফসাইড’ এ দুটি ছবি দেখলে। তেমনি ‘দিস ইজ নট এ ফিল্ম’ ক্লোজড কার্টেন, ‘থ্রি ফেসেজ’ ‘ট্যাক্সি’ ছবিগুলি ইরান সরকারের দমনপীড়ন নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার চিত্রস্বর।
শেষোক্ত চারটি ছবি জাফর নির্মাণ করেন গেরিলা পদ্ধতিতে, যখন তিনি গৃহবন্দী ছিলেন। ছবিগুলি লুকিয়ে প্যান ড্রাইভের মাধ্যমে কান ও বার্লিন উৎসবে পাঠানোর পর যখন সেখানে আলোড়িত ও পুরস্কৃত হয়, তখন ইরান সরকার বিব্রত হয়ে পড়ে এবং জাফরের ওপর তাদের ক্ষিপ্ততার পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ট্যাক্সি ছবির গড়নটাই অভিনব। একটি ট্যাক্সিতে গোপনে ক্যামেরা বসিয়ে তেহরানের রাজপথে ঘুরে ঘুরে জাফর সাধারণ মানুষের সঙ্গে (ট্যাক্সির আরোহী) আলাপ করলেন দেশের পরিস্থিতি, লিঙ্গ বৈষম্য, দারিদ্র্য, রাজনীতি, বাক স্বাধীনতা, উৎপীড়ন নিয়ে। সে সব কথোপকথনকে সাজিয়ে তৈরি করলেন– ‘ট্যাক্সি’ এবং গোপনে পাঠিয়ে দিলেন কান ও বার্লিনে এবং ছবিটি পুরস্কৃত হলো বার্লিনে, আর বিশ্ব জেনে গেল ইরান সরকারের চরমপন্থার বিশদ বিবরণ। স্বভাবতই ক্ষেপে গেল সরকার।
জাফর পানাহিকে ইরান সরকার প্রথম আটক করে ২০০৯ সালের ৩০ জুলাই তেহরানে সুফী সাধক নেদা আগা সোলতানের মাজার থেকে। পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হলেও পাসপোর্ট জব্দ করা হয় এবং তাঁর বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ২০১০ সালের ১ মার্চ জাফরকে স্ত্রী তাহেরেহ সাইদি, কন্যা সালমাজ পানাহি এবং তাদের ১৫ জন সহকর্মীসহ বাড়ি থেকে সাদা পোশাকের নিরাপত্তা কর্মীরা গ্রেফতার করে তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে নিয়ে যায়। সারা বিশ্বের সাংস্কৃতিক মহল এ অন্যায় আটকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঝড় ওঠে ইরানেও। ২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রী বিবৃতি দেন জাফর পানাহিকে আটকের ব্যাখ্যা দিয়ে। তিনি বলেন, ‘জাফর এমন সব ছবি করছিলেন, যেগুলি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল’। ইরানের ৫০ জন চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা ও কলাকুশলী পানাহির মুক্তির দাবিতে সরকারের কাছে স্মারকলিপি দেন। সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র জগতে নানা ধরনের কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। ২৫ মে আদালত জাফর পানাহিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন ২ লক্ষ মার্কিন ডলারের জামিনে। তবে ২০ ডিসেম্বর জাফরের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ সেই দিন।
২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর দীর্ঘ শুনানির শেষে আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন এবং চলচ্চিত্র পরিচালনা, প্রযোজনা, চিত্রনাট্য রচনা, দেশি বিদেশি যে কোনো ধরনের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রদান ও দেশের বাইরে যাবার ক্ষেত্রে বিশ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বিশ্বজোড়া প্রতিবাদ ও দেন দরবারের পরে দুই বছরের কারাবাসের শেষে তাঁর দন্ডাদেশ খানিকটা শিথিল করে তাঁকে ছয় বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। তবে ছবি নির্মাণ ও দেশের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। শেষ পর্যন্ত কারাবাসও শিথিল করে গৃহান্তরীণ করে রাখা হয় তাঁকে। কিন্তু তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে গোপনে ছবি নির্মাণ করে গেছেন। গৃহ কারাবাসের দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে রসদ করে ২০২৫ সালে তাঁর রাহুমুক্তি ঘটেছে।
চলচ্চিত্র সমালোচক সায়নদেব চৌধুরীর মতে পানাহি তাঁর উপর নেমে আসা যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাকে সৃষ্টিমূলকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে এক ধরনের নতুন ফর্ম তেরি করে ফেললেন। এ ছবিগুলি শুধুমাত্র কিছু বক্তব্যের খতিয়ান নয়, বরং ইরানের মুক্তিকামী মানুষের এক ধরনের বিকল্প সংবিধান। ইট ওয়াজ জাস্ট এ্যান এ্যাক্সিডেন্ট ছবির বিষয়, যেখানে পাঁচ ব্যক্তি বিভিন্ন ঘটনায় জেরবার হতে হতে উপলব্ধি করে যে, কারাগারে তাদের অত্যাচারীকে তারা অবশেষে চিহ্নিত করতে পেরেছে। ব্ল্যাক কমেডি, থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার আর দর্শনের মিশেলে এই ছবি মন কেড়েছে কানের জুরিদের।
২০২৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে জাফর পানাহির নতুন ছবি ‘ইট ওয়জ জাস্ট এ্যান এক্সিডেন্ট’ উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার-‘পাম দ্য অর’ অর্জনের পর দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জাফর বলেন, ‘প্রথমবার কারাবাসকালে আমাকে নিভৃতে, একেবারে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। একটা ক্ষুদ্র সেল–এ থাকতাম আর মাঝে মাঝে আমাকে চোখে কাপড় পরিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত। পিছন থেকে একটাই কন্ঠস্বর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। কোনওদিন দু’ঘন্টা, কোনওদিন আট। এই কন্ঠস্বরটাকে ঘিরে আমার বেশ কৌতূহল তৈরি হল; ওই গলার পিছনে কে, প্রায়শই সেটা ভাবতাম। তখনই মনের মধ্যে কোথাও একটা বাসনা তৈরি হল যে, একদিন ও কন্ঠস্বরটাকেই একটা সৃজনশীল রূপ দিতে হবে। (অনুবাদঃ সায়নদেব চৌধুরী)। বলাই বাহুল্য, ভয়ানক সেই কন্ঠস্বরই হচ্ছে ভয়ঙ্কর সেই অত্যাচারী ।