দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ২৫ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:০৮ পূর্বাহ্ণ

অলৌকিক যখন লৌকিক

দেশে এখন অলৌকিকত্বের জয় জয়কার। এতো অলৌকিকতা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। মূলত ধার্মিক আর সৎ মানুষের হাত থেকে ছুটে গেছে সবকিছু। এখন যারা অন্ধকারের দিকে টানে তারা একাত্তর মানে না। শহীদ মানে না। নেতা মানে না এমনকি অলৌকিকভাবে পাওয়া স্বপ্নের দেশটাও মানতে চায় না । তাদের জন্য এই লেখাটা, হয়তো আসল অলৌকিকত্ব তাদের স্পর্শ করবে। অলৌকিক বলে কি আসলেই কিছু আছে? না এটা সম্পূর্ণ মনোজাগতিক? এ নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচুর তর্ক হয়েছে, চলছে এবং চলবে। সে হোক, আমি সংশয়বাদী মানুষ। ঈশ্বর ও প্রকৃতি শূন্যও মহাশূন্য দুই ই টানে সমান ভাবে। কয়েকটি ছোট্ট ঘটনার কথা বলছি যার সবগুলোই সত্য অথচ ব্যাখ্যাহীন।

বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁকে আপনি গালমন্দ করতে পারলেও এড়াতে পারেন না। চমৎকার গদ্য লিখতেন। একবার লিখেছিলেন তাঁর এক আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুর সাথে রাতে ঘুরছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ঘুরতে ঘুরতে রাত দুপুরে তাদের চায়ের তেষ্টা পেলে তারা এগুতে থাকলেন চা দোকানের দিকে। দেখলেন ওদিক থেকে হনহন করে হেঁটে আসছেন একজন পাগল কিসিমের মানুষ। দূর থেকে দেখেই বুঝলেন রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। উদোম গা। লুঙ্গি আর হাতে কিছু একটা। হুমায়ূন আহমেদ লিখছেন তাঁর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এই পাগলা লোকটিকে বলেন, সালাম আলাইকুম। কিন্তু পারছেন না। পাশে আমেরিকা প্রবাসী বিজ্ঞানী বন্ধু। ভাববে ও মুখে মুখে প্রগতিশীলতা আর রাত দুপুরে ফকির দেখে ভক্তিতে গদগদ। তো তাঁরা হাঁটছেন পাগলাও এগিয়ে আসছেন। কাছাকাছি হতেই লোকটি হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে বেশ জোর গলায় হাঁক দিয়ে বলেছিলেন: ওয়ালাইকুম আসসালাম। স্তম্ভিত বিচলিত হুমায়ূন আহমেদ থতমত খেয়ে গেলেন বটে কিন্তু এর জট খুলতে পারেন নি কোনদিন।

আমি তখন চট্টগ্রামে। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরী করি। আমি কাজ করতাম জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে। সেখানে দারোয়ান পিওন ম্যাসেঞ্জারের ছড়াছড়ি। এর ভেতর একজন ছিলেন যিনি দেখতে ছোটখাটো। যতদূর জেনেছি দু বিবি নিয়ে থাকেন। সংসারও কম বড় না । কিন্তু কাজে ফাঁকি দেয়ার লোক ছিলেন না। যেটা হয় ফাই ফরমাশ খাটলে সবাই কিছু না কিছু দেয় একে কিছু দিলে পাই পয়সা হিসেব করে ফেরত দিতেন। আমার প্রতি তার কেমন জানি একটা টান ছিলো। জানতো আমি চা খাই। ভালোবাসি চা পান করতে। অন্যদের জন্য আনলেও এককাপ আমার টেবিলে হাজির হবেই। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলতো আর কাজ করতো আমি বেশ হিমশিম খেয়ে যেতাম তার কারণ খুঁজে বের করতে। একবার হৈ হৈ কাণ্ডআমাদের অফিসে এলেন ব্যাংকের এমডি। বাংলাদেশে যা হয় পারলে তার জুতা সাফ করে দিতে প্রস্তুত একশ জন। আমরা তখন নবীন অফিসার। কে আমাদের খবর রাখে? ব্যাংকের ফ্লোর জুড়ে একটা ছোট কাচঘেরা রুম ছিলো মন্দিরের মতো। সেখানে ঢুকতে জুতা খুলতে হতো। আর যখন তখন বা যেউ ঢোকা মানে পরদিন পাহাড় জঙ্গলে বদলী। যে দুজন ঐ রুমে বসতেন তাদের হাবভাব ছিলো আলাদা। তারা যে কি করতেন কেন করতেন কেউ জানতো না। এখন বুঝি সারাদিনে দু একটা এক্সেল সিট তৈরী করা ছাড়া আর কিছুই হতো না ওখানে। সে যাই হোক। যেদিন এমডি এলেন সাজ সাজ রব। সন্ধ্যার পর তিনি ঢুকলেন সে রুমে। বাইরে ফ্লোরে আমরা যার যার আসনে দাঁড়িয়ে। যত সময় তিনি ফ্লোরে থাকবেন তখন কেউ বসবে এটা কি হয়? দেশীয় কায়দায় আদব বলে কথা। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই লোক ইলিয়াস আলী। বিড়বিড় করে সুরা বা কিছু পাঠ করা তার স্বভাব। তেমন কিছু করছিল মনে হয়। হঠাৎ একটা বড় ফুঁ দিয়ে আমাকে ফিসফিস করে বললো এমডি সাহেব কিন্তু এখন আপনার কাছে আসবে। আমিতো বিরক্তির চরমে। চাপা গলায় জোর দিয়ে বললাম, চুপ কর। তোর কিন্তু খবর আছে আজকে। দেখি মিটমিট করে হাসছে। আমার রাগ তখন চরমে। এমডি কম্পিউটার রুম থেকে বেরিয়ে গটগট করে জিএম চেম্বারের দিকে যাবার পথে হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা মাঝখানের সারিতে আমার সামনে। আমার তো রীতিমত ঘাম বেরুচ্ছে। বলে কি! আমি কি কাজ করি কি কি দেখি এসব দু একটা মামুলী প্রশ্ন করেই পাশে দাঁড়ানো বড় এক কর্তাকে বললেন, একে আমাদের হেড অফিসে বদলি করুন। পাবলিক রিলেশানস অফিসার হিসেবে। পাশের কর্তাতো পারলে আমাকে তখনই ট্রেনে তুলে দেয়। আমার তখন মাথা ঘুরছে। বলা নাই কওয়া নাই আমি যাবো ঢাকায়? পাবলিক রিলেশান যতটা আর যতবেশী আকর্ষক হোক না কেন আমিতো প্রস্তুত না তখন। তখন আমার অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন ভিসা হাতের মুঠোয়। সেটা ভিন্ন কাহিনী। হঠাৎ করে এমডি পোর্ট ফোলিওর কেউ আমার কাছে চলে আসবেন, তাও ইলিয়াস হুজুরের আগাম বলা কথা মতো? এ ঘটনার কোন ব্যাখ্যা আমি পাই নি আজো। যেমন পাই নি অন্ধ হাফেজের বাণীর। যিনি আমার হাত ধরে বলেছিলেন, বিদেশেই যাবে। ওখানেই হবে যা হবার।

তারুণ্যে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পছন্দ করতাম। আসলে স্বপ্নগুলো সফল হতো নাতো এভাবে বলেই আমরা শান্তি পেতাম হয়তো। সন্ধ্যায় আমি প্রায়ই চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনে যেতাম। একবার গিয়ে দেখি স্বামীজী এসেছেন ঢাকা থেকে। স্বামী অক্ষরানন্দজী। আমিও গেলাম একান্তে দেখা করতে। কি চমৎকার গৈরিক বসন। মাথায় টুপি। দেখে শুনে মুগ্ধ আমি তাঁকে বললাম, সাধু হতে চাই। কি করতে হবে? সব শুনে স্মিতহাস্যে বললেন তোমার দরকার নাই সাধু হবার তুমি যা ভালোবাসো তাই করো। আমি আমার ছোট লাল নোট বইটা মেলে দিয়ে কিছু লিখে দিতে অনুরোধ জানালে তিনি আমাকে বিস্মিত করে লিখেছিলেন আজীবন সত্য কথা বলিবে। আমি তখন ঘামছি। আমি যে মিথ্যা বলি উনি জানলেন কিভাবে? সেই বোধহয় আমার বানিয়ে বানিয়ে বলা গল্পের শেষকাল। এমন অভিজ্ঞতা বিদেশেও ঘটেছে। বারান্তরে বলা যাবে সে সব।

লেখক : কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসার অপর পৃষ্ঠা
পরবর্তী নিবন্ধশেখ-ই-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার : একটি আবেদন