দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারবাসীর শত বছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটারের বহুল প্রতীক্ষিত রেল লাইন নির্মাণের মাধ্যমে। এতে সারাদেশের সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের রেলপথে ট্রেনে চেপে যোগাযোগের সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এই রেল লাইন নির্মাণ করতে গিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এতে কাটা পড়েছে তিন লাখের বেশি হরেক রকমের বৃক্ষরাজি। তদ্মধ্যে বেশিরভাগই পূর্ণবয়স্ক গর্জন প্রজাতির মাদার ট্রি। এছাড়াও ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে বন–জঙ্গলের প্রাণ–প্রকৃতি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিগত সরকারের নেওয়া বনের ওপর দিয়ে এই রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় বলা হয়, সংরক্ষিত বনের ওপর দিয়ে রেল লাইন নির্মাণে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশগত প্রাণ–প্রকৃতির যে ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে নিতে রেল লাইনের দুই ধারে ৬ লাখ গাছ রোপণ করা হবে। কোন কোন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হবে তাও চূড়ান্তভাবে নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া আছে প্রকল্প প্রস্তাবনায়। প্রকল্প সূত্র জানায়– বনজ, ফলদ, ফুলসহ শোভাবর্ধনকারী হরেক প্রজাতির গাছের চারা রোপণের কথা থাকলেও সেখানে প্রকল্পের ১০০ কিলোমিটার জুড়ে লাগানো হয়েছে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত আকাশমনি (একাশিয়া গাছ)।
শর্তাবলীতে যেসব গাছের চারা রোপণ করতে বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে– বনজ গাছের মধ্যে গর্জন, শাল, শিল কড়ই; ফলদ গাছের মধ্যে ছিল আম, কাঁঠাল, কাঠ বাদাম, কালো জাম, গাব, লিচু, সফেদা, জামরুল, ডালিম, খেজুর ও খেজুর প্রজাতির পাম্প ট্রি। রেল লাইনজুড়ে দুই ধারে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ ফুটিয়ে তুলে দেশি–বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ও জারুল গাছের চারা রোপণের কথা ছিল। কিন্তু মূল্যবান বনজ, ফলদ ও ফুলগাছগুলো রোপণ করা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, ইতোমধ্যে এই বনায়ন প্রকল্পের কাজ কাগজে–কলমে শেষ করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সমুদয় বিলও তুলে নিয়েছে। কাগজে–কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে রেল লাইনের এই বনায়ন কর্মসূচিতে। বন নিয়ে গবেষণায় যুক্ত অনেকে এই প্রকল্পটিকে লুটপাটের প্রকল্প হিসেবেও দেখছেন।
বন গবেষক ইখতিয়ার উদ্দিন আহমদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, সংরক্ষিত বন–জঙ্গলের পরিবেশ ধ্বংস করার পরও রেল লাইনের দুই ধারে বনায়ন প্রকল্পের দরপত্রের শিডিউল অনুযায়ী যদি ৬ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হতো তাহলে ধীরে ধীরে বনের হারানো পরিবেশ ফিরে আসতো। কিন্তু আমরা দেখলাম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকারি টাকার জলাঞ্জলি দিয়ে ভাগ–বাটোয়ারা করা হয়েছে।
তথ্য মতে, তড়িঘড়ি করে বিদেশি প্রজাতির সহজলভ্য আকাশমনি গাছের চারা রোপণ করে সমুদয় বিল উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি না থাকাসহ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে মূল্যবান গাছের চারার পরিবর্তে স্বল্পমূল্যের গাছের চারা রোপণ করে যেনতেনভাবে কাজ শেষ করা হয়েছে।
পরিবেশবাদী অনেকের ভাষ্য, সরকার যেখানে একাশিয়া ম্যানজিয়াম গাছকে ঘোষণা দিয়ে পরিবেশবিধ্বংসী বলে নিষিদ্ধ করেছে, তা অমান্য করে সেই গাছ রোপণের মাধ্যমে রেল লাইনের বনায়ন প্রকল্প শেষ করেছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে রেল লাইন নির্মাণের কারণে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা বিদেশি প্রজাতির আকাশমনির মতো নিম্নমানের গাছ রোপণ করে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। তাছাড়া রোপিত এসব গাছের চারাও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় অনেক স্থানে প্রকল্পের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক স্থানে একটা গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে তাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে জানার জন্য রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সবুক্তগীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তথ্য মতে, রেল লাইন নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপ কাজ সম্পাদন করেছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের চকরিয়ার সাহারবিল পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটারজুড়ে। অবশিষ্ট ৪৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন করেছে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন।