যে কোনো দেশের সরকারকে রাজস্ব আদায় করার জন্য ট্যাক্স এবং ট্যারিফ এই দুইটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। ট্যাক্সকে বাংলা করা হয়েছে ‘কর’ আর ট্যারিফকে করা হয়েছে ‘শুল্ক’। অর্থনীতির আলোচনায় কর শুল্কের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। করের সংজ্ঞায় বলা হয়– ‘সরকার কর্তৃক আরোপিত অর্থ যখন জনগণকে বাধ্যতামূলক প্রদান করতে হয় এবং যা থেকে জনগণ প্রত্যক্ষ কোন সুবিধা আশা করে না তাহাই কর। অপরপক্ষে কোনো আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর সরকার যখন নির্ধারিত হারে অর্থ আদায় করে তখন তাকে ট্যারিফ বা শুল্ক বলে। কর ও শুল্কের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো যে, কর আরোপ করা হয় কোনো ব্যক্তির আয় বা সম্পদের ওপর, আর ট্যারিফ আরোপ করা হয় আমদানি বা রপ্তানি পণ্যের ওপর। আবার কর প্রদান বাধ্যতামূলক, কিনু্তু ট্যারিফ বা শুল্ক বাধ্যতামূলক নয়। কর থেকে কোনো ব্যক্তি প্রত্যক্ষ কোনো সুবিধা আশা করতে পারে না। কিন্তু ট্যারিফ বা শুল্ক থেকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিশেষ কোনো সুবিধা আশা করতে পারে। মোট কথা, কর হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে নাগরিক বা ব্যবসা বাণিজ্যের আয়ের ওপর আরোপিত অর্থ। আর ট্যারিফ বা শুল্ক হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর আরোপিত অর্থ যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক পরিশোধ করতে হয়।
প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রনীতি অনুসারে সরকার দেশের অভ্যন্তরে জনগণের আয়ের ওপর, উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ওপর কর আরোপ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে। কর ও শুল্ক আরোপের পরিমাণ নির্ভর করে ক্ষমতাসীন সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির ওপর। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের পূর্বে প্রতিটি রাজনৈতিক দল জনগণের নিকট যেসব ওয়াদা নিয়ে থাকে ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো সেইসব ওয়াদা বাস্তবায়ন করা শুরু করে। ফলে রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত কর বা শুল্কের পরিমাণ পণ্য ও দেশভেদে ভিন্ন হয়। আবার সরকার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ ভেদে অথবা নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক সুবিধা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ওপর ভিন্ন ভিন্ন শুল্ক আরোপ করতে পারে। এটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক নিয়মে সরকার পরিবর্তন হলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে খুবই কম দেশ। ২০২৫ সালে পৃথিবীর অতি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সমগ্র বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক আরোপের পরিমাণ পরিবর্তন করে নিজ দেশকে গ্রেড করতে গিয়ে অন্যান্য দেশসমূহ পড়েছে বিপাকে। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে ধারাবাহিকতা চলে আসছিল তা সম্পূর্ণরূপে নড়চড় হয়ে যায়। সমগ্র বিশ্বের বিশাল বিশাল অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারাকে নাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব অর্থনীতির হিসাব নতুন করে কষা শুরু করে। শুল্ক আরোপের সাথে বিশ্ব রাজনীতি যুক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিও ঘুরে বসে। ফলে সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতি হয়ে যায় ভবিষ্যৎ বাণীর অনিশ্চয়তা। একই অঞ্চল, একই মহাদেশ, একই দুরত্ব, অথচ এক এক দেশের ওপর এক এক রকম শুল্ক আরোপ। এ অবস্থায় শুল্ক আরোপের পরিমাণ হয়ে যায় পারস্পারিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে। যে দেশের সাথে ভাল সম্পর্ক রয়েছে সেই দেশের ওপর কম শুল্ক আরোপ করা হয়। আর যে দেশের সাথে সম্পর্ক শীতল সেই দেশের বাণিজ্যের ওপর অধিক শুল্ক আরোপ করা হয়। এর ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা স্থানান্তরিত হয়েছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
বিশ্ব রাজীনতির এই নির্মম নীতির কারণে পৃথিবীর অনেক দরিদ্র দেশকে তুলনামূলক অধিক দামে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এতে আমদানিকারক দেশটিতে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ঐসব দেশকে অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রিজার্ভের পরিমাণ হ্রাস পাবে। পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণে সংশ্লিষ্ট দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় হ্রাস পাবে। আমদানি ব্যয় বেশি হবার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম হয়ে যাবে। আর গ্রেড অর্থনীতি হয়ে উঠবে অতি গ্রেড।
ইউরোপের বিশাল বিশাল অর্থনীতিবিদরা বিভিন্নভাবে গবেষণা করে দেখিয়েছেন বাণিজ্যকে সহজীকরণ করার পদ্ধতি। কোন পদ্ধতিতে কর বা শুল্ক আরোপ করলে জনগণের উপকার হয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে কীভাবে বৈষম্য কমবে, তা তারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর গবেষণা করেছেন। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জনগণের আয়ের পরিমাণ অধিক। আবার অধিক আয়সম্পন্ন ব্যক্তির ব্যয়ের পরিমাণও অধিক। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, উন্নত দেশের জনগণের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা অধিক। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতে শ্রমের আধিক্য না থাকার কারণে শ্রমের মূল্য অধিক। ফলে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন খরচও অধিক। এসব উন্নত দেশগুলো অধিকাংশ ব্যবহার্য্য পণ্য নিজ দেশে উৎপাদন না করে স্বল্প উন্নত বা অনুন্নত দেশ থেকে আমদানি করে। কারণ স্বল্প উন্নত বা অনুন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা অধিক। ফলে শ্রমের মজুরি অনেক কম। উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে অনুন্নত বা স্বল্প উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নত মানের ব্যবহার্য্য পণ্য আমদানি করে। এতে উন্নত দেশগুলো স্বল্প মূল্যে ভাল পণ্য ব্যবহার করতে পারে। আবার স্বল্প উন্নত বা অনুন্নত দেশগুলোর জন্য এরূপ নীতি আশির্বাদ বয়ে আনে। কারণ স্বল্প উন্নত বা অনুন্নত দেশগুলো বিশাল জনগোষ্ঠীকে এসব পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। তা না হলে এই বিশাল জনগোষ্ঠী বেকার থাকবে। ফলে এরূপ বাণিজ্য পদ্ধতি উন্নত দেশের জন্য যেমন সুবিধা তেমনি স্বল্প উন্নত বা অনুন্নত দেশগুলোর জন্যও সুবিধা।
কিন্তু বিপর্যয় ঘটেছে বিশ্ব বাণিজ্যে শুল্ক হারের বিশাল পরিবর্তনে। আরো বিপর্যয় ঘটেছে যখন সেই বাণিজ্যের মধ্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে কোনো কোনো দরিদ্র দেশ, উন্নত দেশে রপ্তানির অধিক সুবিধা পেয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশ সেই সুবিধা পায়নি। এখানেই সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্য। তবে এ বৈষম্যের পিছনে লুকিয়ে আছে এক নিদারুণ শোষণ। যেমন– বাংলাদেশ নিজের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পাঁচ বছর ধরে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে দাম বেশি দিয়ে হলেও বছরে সাত লাখ টন করে গম কিনতে হবে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আগে থেকেই আমদানি করা হচ্ছে। তা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।