আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়ায় নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ নিয়ে শংকা বাড়ছে। এই ব্রিজটি ভেঙে নতুন ব্রিজ নির্মাণ করার সুযোগ না থাকায় শহরের দুই অংশের সাবলীল যোগাযোগ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে আগ্রাবাদে ওঠা–নামার র্যাম্প যুক্ত করে এক্সপ্রেসওয়েকেই দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। একই সাথে ব্রিজের দেওয়ানহাটের বিদ্যমান স্থানটির পরিবর্তে অন্য কোন জায়গা পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগেরও চিন্তা করা হচ্ছে। তবে ব্রিজটির সবগুলো পিলারই আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে একেবারে ঝরঝরে অবস্থায় রয়েছে। যে কোন দিন এই ব্রিজ শহরের বড় ধরনের ট্র্যাজেডির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে শহরের যোগাযোগের প্রয়োজনে রেললাইনের উপর ব্রিজের ‘উচ্চতার’ বাধ্যবাধকতার আইন শিথীল করে ব্রিজটি একই উচ্চতায় পুর্ননির্মাণ করা গেলে সবচেয়ে ভালো হবে বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা হচ্ছে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ। রেল চলাচলকে কেন্দ্র করে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া বন্দরনগরীর উভয় অংশের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই হচ্ছে এই ব্রিজ। ব্রিজটি ছাড়া শহরের দুই অংশ এবং প্রধান সড়কটির স্বাভাবিক যান চলাচলের কথা চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু দীর্ঘদিনের ব্যবহারে ব্রিজটির আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয় ৬০ বছরেরও বেশি আগে। ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝিতে ব্রিজটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স নামের একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ব্রিজটি নির্মাণ করে। নির্মাণকালীন কিছু ক্রুটির জন্য স্বাধীনতার পরে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের দিকে এসে ব্রিজটিতে বড় ধরণের সংস্কার কাজ পরিচালনার পর সেটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ব্রিজটির স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে বহু বেশি ওজন ধারণ করে টিকে রয়েছে। এই ধরণের ব্রিজ সংস্কারে রিসাইক্লিং কার্পেটিং করা হয়। যাতে আগের পিচ খোদাই করে তুলে সৃষ্ট গর্তে নতুন করে পিচ ঢালাই করা হয়। কিন্তু দেওয়ানহাট ওভারব্রিজে তা হয়নি। এতে করে বিভিন্ন সময় সংস্কারের নামে ব্রিজটির উপর হাজার হাজার টন পিচ ঢালাই করা হয়েছে। এতে ব্রিজটি কেবল উঁচুই হয়নি, নিজের ওজনও বেড়েছে। ‘ডেথ ওয়েট’ নামের এই ওজন প্রতিনিয়তই ব্রিজটির ক্ষতি করছে।
অপরদিকে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ নির্মাণের সময় স্টিল সেক্টরের এমন জয়জয়কার ছিল না। ছিল না প্রকৌশল সেক্টরের বহু কিছু। তথাকথিত বাংলা রড দিয়ে তৈরি ব্রিজটি ধারণক্ষমতার বহু বেশি ওজন বহন করতে হচ্ছে। ষাটের দশকে ব্রিজটি যখন ডিজাইন করা হচ্ছিল তখন কল্পনাও করা যায়নি এমন সব ওজন নিয়ে এই ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। এতে করে দীর্ঘদিনের ব্যবহার এবং ওভারলোডের কারণে আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়া ব্রিজটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
৬০ বছরেরও বেশি পুরানো ব্রিজটির স্ট্রাকচারাল আয়ুষ্কাল হারিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, জোড়াতালি দিয়ে ব্রিজটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এর মূলকাঠামো যেমন পিলার, গার্ডার এবং ক্রস গার্ডারে কোন সংস্কার বা জোড়াতালির সুযোগ নেই। এ জন্য এতে শত শত ফাটল দেখা দিয়েছে। ব্রিজে ব্যবহৃত সেকালের রডগুলোর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রডগুলো ভিতরে ফুলে গেছে, মরিচা ধরেছে। এগুলোর উপর আর ভরসা করার অবস্থা নেই। ব্রিজের নিচের প্রতিটি পিলার, গার্ডার এবং ক্রসগার্ডারের অবস্থা শোচনীয়। গাছগাছালীর জন্মও হয়েছে। ঢালাই খসে পড়ায় পিলার এবং গার্ডারের মরিচা ধরা রড বের হয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি করেছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্রিজটি নিয়ে নগরবাসী শংকা প্রকাশ করেছে। শংকা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ব্রিজটির দায়দায়িত্ব নিয়ে নতুন করে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু বিষয়টি খুব বেশিদূর এগোয়নি।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নুরুল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ব্রিজটির অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু কিছু করাও যাচ্ছে না। রেললাইনের উপর ব্রিজ নির্মাণে রেলওয়ের উচ্চতার একটি বাধ্যবাধকতা আছে। বর্তমানে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ ৫ মিটারের মতো উচ্চতায় রয়েছে। এখন রেললাইনের উপর ব্রিজ নির্মাণে উচ্চতার বাধ্যবাধকতা হচ্ছে সাড়ে ৮ মিটার বা প্রায় ২৮ ফুট। অর্থাৎ রেললাইন থেকে উপরের দিকে ২৮ ফুট জায়গা ক্লিয়ার রেখে ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। এতো উঁচু করে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হলে স্লোভ মেলানোর জন্য যে পরিমান জায়গা দরকার তা দেওয়ানহাট কিংবা টাইগারপাস প্রান্তে নেই। এতে করে ব্রিজটি যথাস্থানে নির্মাণের সুযোগ নেই। এখন নতুন করে কিছুটা এদিক–ওদিক করে ব্রিজটি নির্মাণ করা যায় কিনা তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে বের করতে হবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি।
সিডিএ চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে এই ব্রিজের বিকল্প করা যায় কিনা সেই চিন্তাও করছি। আগ্রাবাদে ওঠানামার র্যাম্প করা গেলে লালখানবাজারে নামা এবং জিইসি থেকে ওঠার সুযোগ চালু হলে একটি বিকল্প তৈরি হবে। আমরা আগ্রাবাদে ওঠা–নামার দুইটি র্যাম্পই নির্মাণের চেষ্টা করছি।
তবে নগর পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এমন একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের বিকল্প আসলে এভাবে হবে না। ওখানেই নতুন করে একটি ব্রিজ নির্মাণ না করলে যান চলাচলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে রেলওয়ের উচ্চতার বিষয়টি শিথিল করে বিদ্যমান উচ্চতা কিংবা কিছুটা বাড়িয়ে ব্রিজ নির্মাণ করা যাবে। আইনতো মানুষের জন্য, মানুষতো আইনের জন্য নয় বলেও তারা মন্তব্য করেন।
অপর একজন প্রকৌশলী বলেন, প্রয়োজনে রেলওয়ে স্টেশন পাহাড়তলীতে নিয়ে যাওয়া যায়। সেক্ষত্রে শহরের কদমতলী কিংবা দেওয়ানহাট অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত, পাহাড়তলীতে মূল রেলওয়ে স্টেশন হলে সমস্যার কিছু নেই বরং শহরের ভিতরের ঝামেলা কমে যাবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, দেওয়ানহাট ব্রিজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। এই ব্রিজের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওভারব্রিজ কোন কারণে ভেঙে পড়লে শহরের যান চলাচলের ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দেবে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
বিষয়টি নিয়ে গতরাতে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শুধু দেওয়ানহাট ওভারব্রিজই নয়, নগরীর পঞ্চাশ বছরের বেশি পুরানো সবগুলো ব্রিজ নিয়ে আমরা একটি সার্ভে শুরু করতে যাচ্ছি। বিশেষ করে বায়েজিদে একটি ব্রিজ ভেঙে পড়ার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। ওই সার্ভে রিপোর্টের পরই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। ঝুকিপূর্ণ ব্রিজগুলোর ব্যাপারে অবশ্যই বড় ধরণের একটি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হবেন বলেও সিটি মেয়র জানিয়েছেন।