উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থকে রোমান্টিক কাব্যের যুগস্রষ্টা কবি বলা হয়। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কল্পনার জগতকে প্রভাবিত করে প্রকৃতি ও জীবনবোধের মিলন ঘটিয়ে মানুষকে পৌঁছে দিয়েছেন এক আলোকোজ্জ্বল আধ্যাত্মিক জগতে। প্রকৃতি ও জীবনের দুই ভিন্নতর অনুভূতি কবিকে কল্পনার সীমানা পেড়িয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। রোমান্টিক যুগের অন্যতম বিখ্যাত কবি পি.বি.শেলী ওয়ার্ডসওয়ার্থকে প্রকৃতির কবি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। অন্যদিকে উইলিয়াম হ্যাজলিট ওয়ার্ডসওয়ার্থ কে পাহাড়ের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ সম্পর্কে উভয়ের মন্তব্য ছিল সাজুয্যপূর্ণ। কারণ তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, পাহাড়, বর্ণনার মাধুর্যে নিবিড় ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছিল।
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং এস.টি.কোলরিজ্থ এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’ কাব্য চর্চার জগতে এক নতুন যুগের দ্বার উন্মোচিত করেযা ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে রোমান্টিক যুগ নামে খ্যাত। এলিজাবেথান (১৫৫৮–১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ), অগাস্টান (১৮০০ শতাব্দী) যুগের ভাবধারা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতির উদার আহ্বানে নিবিষ্ট থেকে জীবনকে সহজ, সরল, সাবলীল ও আড়ম্বরহীন ভাবে প্রকাশ করে ওয়ার্ডসওয়াথ সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল। অভিজাত চরিত্র সৃজনে বাহুল্য বা আড়ম্বরতা বাদ দিয়ে পাহাড়, নদী, হ্রদ, জলাশয়, সবুজ বৃক্ষরাজি এমনকি গ্রামীণ জীবন থেকে নেয়া রাখাল, গ্রাম্য বালক বালিকা সাধারণ মানুষই তাঁর সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মে স্থান করে নিয়েছিল। তাঁর সাহিত্যের ভাষা ছিল সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। সহজ, সরল সাহিত্যের ধারা তাঁর সৃজিত সাহিত্য জগতে এক নতুন শৈল্পিক চেতনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। সূক্ষ্ম জীবনবোধ, মানব হৃদয়ের সুপ্ত বর্ণনা এবং প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য চিত্রায়ণ ওয়ার্ডসওয়ার্থের অধিক সংখ্যক কবিতায় অত্যন্ত চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর “Solitary Reaper” নিঃসঙ্গ শষ্য কর্তনকারীও কবিতায় পাহাড় বনানী ঘেরা এক উপত্যাকায় নির্জন পরিবেশে প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য এবং পাহাড়ী বালিকার মধুর সুরে গান গাওয়া ও শস্য কর্তনের বর্ণনায় কবি নিবিষ্ট হয়ে যান প্রকৃতির সহজ সরল প্রাণবন্ত ও নৈসর্গিক আনন্দধারায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কবি তাঁর এক বন্ধু এবং বোন ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থকে সাথে নিয়ে স্কটল্যান্ডের পার্বত্য অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে পাহাড় বেষ্টিত উপত্যকার মাঝে প্রকৃতির স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশে পাহাড়ি বালিকার গানটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে কল্পনার এক ভাবজগত থেকে নিজেকে বাস্তব এক অনন্য সুন্দর পরিবেশে দেখতে পান। সফরসঙ্গীদের দৃষ্টি ফেরাতে বলে ওঠেন –
“Behold her, single in the field/ Yon solitary highland lass! Reaping and singing by herself” এ বর্ণনায় প্রকৃতির নির্জন পরিবেশে একাকী শষ্য কর্তনকারী পাহাড়ি বালিকার বাস্তব ছবি যেন কবি সবার সামনে তুলে ধরেন। এখানে কবির বিমুগ্ধ প্রকৃতি প্রেম অত্যন্ত সহজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। তাঁর এ কবিতার সহজ বর্ণনায় কোনো অস্বাভাবিকতা বা প্রতীকের ব্যবহার নেই বললেই চলে। প্রকৃতির প্রতি তাঁর কবি হৃদয়ের বাস্তব অনুভূতি প্রতিফলিত হয়েছে।
“I Wandered Lonely as a Cloud” কবিতায় কবি ডেফোডিল ফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যকে প্রকৃতির বুকে আনন্দের ফল্গুধারার নিগুঢ় বাস্তবতার ঐন্দ্রজালিক সুষমায় রূপান্তরিত করেছেন। হ্রদের ঢেউয়ের সাথে মৃদু বাতাসের দোলায় ড্যাফোডিল ফুলের নৃত্যের তুলনা বাস্তবে আত্মিক অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল যা কবির হৃদয়ে আনন্দের ধনভাণ্ডার হয়ে শাশ্বত স্থান দখল করে নিয়েছিল। এ দৃশ্য কবির অন্তরে কবিগুরুর উপলব্ধির সাথে একাত্ম হয়ে গেয়ে উঠে -‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে’।
পরবর্তীতে অনির্বচনীয় সৌন্দর্য ফুটে উঠেতাঁর পাহাড়, নদী, মাঠ, পাখি, জলের সৌন্দর্য সমৃদ্ধ প্রেলুড, টিনট্রার্ন এবে, ইন্টিমেশন অন ইর্মরটালিটি ইত্যাদি বিখ্যাত কবিতা সমূহে। কবি সৃষ্টির সৌন্দর্য মহিমার নিখুঁত উপমা খুঁজে পান প্রকৃতির নৈসর্গিক বর্ণনায়। প্রকৃতি প্রেমিক ওয়াডসওয়ার্থ তাঁর টিনটার্ন এবে কবিতায় যেন শহরের কোলাহল ছিন্ন করে ওয়ে নদীর বনানীর নিবিড় সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে নিজেকে প্রকৃতির নৈসর্গিক পরিবেশে আবিষ্ঠ করে নেন। প্রকৃতির গভীর জীবন্ত সত্তার মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেন। মহত্তর চিন্তার অভিব্যক্তি প্রকাশে নির্জন বনানী, মাঠ প্রান্তর ওনৈসর্গিক সৌন্দর্য মাঝে তাঁর জীবন্ত সত্তার অস্তিত্বঅনুভব করেন। টিনটার্ন এবে বা টিনটার্ন মঠ রোমান্টিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ রচিত একটি বিখ্যাত কবিতা। তিনি কবিতাটিতে প্রকৃতির বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। তাঁর লেখা কবিতার মধ্যে এটি অন্যতম সুন্দর কবিতা যেখানে মনে হবে কবি যেন নিবিষ্ট মনে প্রকৃতির পূজায় নিমগ্ন। কবিতাটি ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ–এ তাঁর বিখ্যাত সংকলন “Lyrical Ballad” প্রকাশিত হয়। প্রথম ভ্রমণে এসে ওয়ে নদীর মঠটি এবং তার পারিপার্শ্বিক দৃশ্যাবলী দেখে তিনি খুবই অভিভূত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার বোন ডরোথি কে সাথে নিয়ে আবারো সেখানে গেলে তাঁর হৃদয় নিভৃতে থাকা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটান এ কবিতাটি রচনার মধ্য দিয়ে। কবি প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং প্রকৃতি সম্পর্কে কবির চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল এ কবিতায়। জলের ধারা, ওয়ে নদীর তীরে খাড়া পাহাড়, সবুজ বনানী নিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনার চিত্র এ কবিতায় সুনিপুণভাবে বর্ণিত হয়েছে। কবির ধারণা, মানুষের যন্ত্রণা কাতর মন প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে নিরাময় ক্ষমতা ফিরে পায়। মানুষকে কিভাবে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে হয় সে উপলব্ধি এ কবিতায় প্রাণবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। তাঁর ধারণা মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে পারলে প্রকৃতি কখনো মানুষের সাথে প্রতারণা করে না বরং প্রকৃতিই তার অনিন্দ্যসুন্দর মায়ার আকর্ষণে মানুষকে কাছে টেনে প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকতে প্রেরণা জোগায়। প্রকৃতি প্রেম তাঁর কাছে কত প্রিয় তার প্রকাশ কবিতার শেষ লাইনগুলোতেই সুস্পষ্ট :
“And this green pastoral landscape, were to me
More dear, both for themselves and for thy sake?
কবি তাঁর বোন ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থকে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষ যদি প্রকৃতিকে ভালো বাসে প্রকৃতি কখনো মানুষকে ঠকায় না। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে পারলে মনের ভেতর অদ্ভুত আনন্দ ও প্রশান্তি আসে। কবি তাই তাঁর বোনকে প্রকৃতির পূজারী হয়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন।
Ode on Intimation of Immortality, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। এ কবিতায় প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য রূপ যেন স্বর্গীয় অনুভূতিতে মিশে গিয়ে এক অনাবিল সৌন্দর্য ধারায় উৎসারিত হয়েছিল।
কবির তৃষিত মন সৃষ্টি কর্তার অপার্থিব মহিমা মাঝেপার্থিব জীবনের প্রতিফলন খুঁজে পেয়েছিল। নৈসর্গিক প্রকৃতি মাঝে সৃষ্ট জীবদের আনন্দ মাঝে নিজেকে সমর্পিত করেছেন।
প্রকৃতি, সমাজ ও মানব জীবনের উৎকর্ষতা ব্যক্ত করাকবির জীবনী মূলক অন্যতম সৃষ্ট কর্ম তাঁর ‘প্রেলুড’ কবিতাটি। অসমাপ্ত এ কবিতাটির মধ্যে মানুষ, প্রকৃতি ও সৃষ্টির মাঝে আধ্যাত্মিকতার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। কবির “Upon West Minister Bridge’’ কবিতায় লন্ডন শহর জুড়ে ভোরের অচেনা সৌন্দর্য কবি মনকে সতত আন্দোলিত করেছিলো। দিনের কোলাহল পরিবেশে ব্যস্ততা শুরুর প্রাক্কালে শহরের বিশুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সৌন্দর্যের বর্ণনা পরিস্ফুট হয়েছে এ কবিতায় যার অতুলনীয় উচ্ছ্বাস কবিকে অভিভূত করেছিল। জাহাজ, মিনার, অট্টালিকাগুলো রোদে ঝলমল করছিল। কবি উপত্যকা, শিলা ও পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে থাকা সকালের অপরুপ সৌন্দর্য খুঁজে পান। প্রগাঢ় শান্তি ও প্রশান্তিতে তাঁর কবি হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল।
আবার “The tables turned” কবিতায় তিনি বই ফেলে প্রকৃতি থেকে জ্ঞান আহরণ করতে উপদেশ দিয়েছেন। কবির মতে পাখি হবে সাজক, প্রকৃতি হবে শিক্ষক, ভালোমন্দ, শুভ আনন্দে কবি তাঁর উদার গভীর অনুরাগে প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন। পার্থিব জগৎ তাঁর সমস্ত মহিমায় প্রকৃতিকে পুণ্য ময় করে তুলেছে। সেখানে প্রকৃতির সাথে জীবনের গভীরতর মেলবন্ধন, জীবনের সৌন্দর্য যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাথে একাকার হয়ে আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি মানুষের প্রতি কবির ভালোবাসা মমত্ববোধ অনুপ্রেরণা জোগাবে প্রকৃতি প্রেমী সাহিত্যানুরাগীদের। ওয়াডসওয়ার্থ–এর কবিতা যতই পাঠ করা হবে ততই পাঠকগণ তাঁর প্রকৃতিপ্রেমে উদ্দীপিত হবেন। “Ode on Intimation of Immortalit’’ কবিতার শেষ লাইন গুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে কবির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার লেখাটি শেষ করছি।
“Thanks to the human heart by which we live
Thanks to tenderness, its joys and fears,
To me the meanest flower that blows can give
Thoughts that do often lie too deep for tears”.
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, প্রাক্তন অধ্যক্ষ রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ ও বর্তমানে রেক্টর বনফুল
আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজ, ঢাকা।