সৃজন ও মননের ঝলমলে আকাশ থেকে কোন পূর্বাভাষ না দিয়েই নীরবে ঝরে গেল উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, কালধারা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা, এ্যাপেক্সসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট সজ্জন অমায়িক, মিষ্টভাষী ও অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী অত্যন্ত জনপ্রিয় এই নক্ষত্রটির নাম মহিউদ্দিন শাহ্্ আলম নিপু। যিনি আলো ছড়াতে ছড়াতে তার পরিসরকে বিরাট বিস্তৃত করে নিজে একটি মহীরুহ হতে পেরেছিলেন আরো শাখা–প্রশাখা বিস্তারের আশায় তাঁর অগ্রযাত্রা ছিল বহমান। নতুন প্রজন্মের জন্য সম্ভাবনাময় পথরেখা সৃষ্টি করার জন্য অদৃশ্য এক অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছিলেন তিনি। মনের ভেতরে সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা লালন করে তীক্ষ্ণ ধী–সম্পন্ন ও প্রজ্ঞাময় এই মানুষটি এগুচ্ছিলেন। কিন্তু এক অবিশ্বাস্য আকস্মিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রজ্বলিত প্রদীপটি নিভিয়ে দিল এক পলকে। অকালে ঝরে গেল স্বমহিমায় উদ্ভাসিত প্রতিভাদীপ্ত চির উদ্যমী একটি জীবন।
গত ২ আগস্ট ২০২৫ সকালে ফেসবুকে তাঁর মৃত্যু সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ার পর শুধু চট্টগ্রাম নয় পুরো দেশজুড়ে নেমে এলো গভীর শোকের ছায়া। তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের সাথে তাঁর নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই অমায়িক সুস্থ সবল মানুষটি ঢাকায় এ্যাপেক্স এর একটি অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ করে প্রাণহীন দেহ নিয়ে প্রিয় চট্টগ্রামে ফিরেছেন, এটা যেন ভাবাই যায় না।
নিপু ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচয়ের সূত্রটা চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রী পরিষদকে ঘিরে। প্রথম যে পাঁচজনকে নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির কমিটি গড়ে উঠেছিল জনাব মহিউদ্দিন শাহ্ আলম নিপু তাদের একজন। সাখাওয়াত হোসেন মজনু ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি। বাকি তিনজন ছিলেন এস এম খোরশেদ আলম, ডা. কিউ এম অহিদুল আলম, ডা. মাহফুজুর রহমান। সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’র মাননীয় সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ। এই কমিটিটি গড়ে উঠেছিল ১৯৮৭ সালের ১৮ জুন।
আমার সাথে নিপু ভাইয়ের পরিচয় ১৯৯০ সালে। সেই থেকে নানা রকম অনুষ্ঠান, অনেক সংগঠন এবং নানা ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা। সংযুক্ত ছিলাম কালধারা পরিষদের সাথে, একুশের বইমেলার সাথে। যতোই দেখেছি তাঁর সফলতা, সচলতা ও আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তরুণ প্রজন্মের জন্য আয়োজিত বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে তাঁদেরকে প্রাণিত করেছেন। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি চট্টগ্রাম একাডেমিরও জীবন সদস্য। এই কর্মপাগল মানুষটি ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিন, কালধারার প্রকাশনা, একুশের বুলেটিন, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদের ম্যাগাজিন ও অ্যালবাম সিআরবি রক্ষায় প্রতিবাদী ম্যাগাজিন, লিফলেট, ব্যানার ইত্যাদি নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় প্রকাশনায় ব্যস্ত থাকতেন। তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমারও একটা আনন্দময় স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমার এবং আমার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মজনু দু’জনের যৌথভাবে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। একই বইয়ে দু’টি প্রচ্ছদ দুই কভার পৃষ্ঠায়। একদিকে কবিতা নাম হচ্ছে ‘ভালবাসা জেগে থাক’; অন্যদিকে গল্প নাম হচ্ছে ‘জীবনের রঙধনু’। দু’টি কভার পৃষ্ঠায় দু’টি প্রচ্ছদ, দু’টি নাম এপিঠ–ওপিঠ। এটি আমার জীবনের প্রথম প্রকাশনা। এই চমৎকার গ্রন্থটি ১৯৯০ সালে নিপু ভাইয়ের প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
গত ৭/৮ মাস যাবত নিপু ভাইয়ের সাথে যোগাযোগটা একটু বেশি হয়েছিল। ইনার হুইল ক্লাব অব লুসাই হিল্স এর ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ম্যাগাজিন বের করার জন্য আমি সম্পাদক হিসেবে চার্টার প্রেসিডেন্ট বোরহানা কবির ও প্রেসিডেন্ট মুনিরাসহ নিপু ভাইয়ের দেওয়ানবাজারস্থ অফিসে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। যথাসময়ে ম্যাগাজিনটি বেরিয়েছে। প্রকাশনা উৎসবও হয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চা–সিঙ্গারা এবং প্রাসঙ্গিক আলাপ আজ বেদনাবিধূর মধুর স্মৃতি। এর পরের পরবর্তী ৩/৪ মাস অনেক আলাপ, ফোনে। কারণ প্রফেসর ডা. মাহমুদ এ চৌধুরী আরজু ভাইয়ের উদ্যোগে অধ্যক্ষ প্রফেসর রওশন আখতার হানিফ–এর একটা স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হবে নিপু ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে নিবেদন প্রেস থেকে। সহযোগী হিসেবে আমি পাশে ছিলাম। আমার লেখা পাঠালাম ই–মেইলে এবং আরো লেখা সংগ্রহ করার দায়িত্ব নিলাম। এ কাজে জড়িয়ে অনেক ঘন ঘন ফোনে কথা হচ্ছিল। আমার জীবনের সুখের কাল পেরিয়ে আমি এখন ক্রান্তিকালে। এই দুঃসময়গুলোতে নিয়মিত আমার খোঁজ–খবর নিয়েছেন নিপু ভাই। আমি ফোন রিসিভ করলেই বলতেন, ‘কেমন আছো ভাই?’ আমার কোনো বড় ভাই নেই। এই মধুর ডাকটি শুনলে মন ভরে যেতো, চোখে জল এসে যেতো। কথার ফাঁকে ফাঁকে মজনুর কথা এসে যেতো। তিনি বলতেন, ‘মজনু চলে যাওয়াতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমরা মজনুকে খুব মিস্ করি। ওকে খুউব মনে পড়ে। ও সময় পেলেই আমার অফিসে চলে আসতো।’ নিপু ভাই, কখনো বুঝিনি আপনাকেও আমরা এমন হঠাৎ করে মিস্ করবো। নাসরিন ভাবী এবং আমি আমরা দু’জনেই চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের সদস্য। আপনি থাকাকালীন শেষ বুধবারে আমাদের ক্লাবের একজনের ছেলের বিয়েতে খুব আনন্দ করেছিলাম। জানতাম না এরপর থেকে বুধবারগুলো অন্যরকম হবে। ভাবী সাহেদা নাসরীন, তিনিও লেখক। তার দুই ছেলে, বড় পুত্রবধূ, মেয়ে ভাই–বোনসহ সকল আত্মীয় পরিজনকে আল্লাহ এ শোক সইবার শক্তি দিন। মহান আল্লাই আপনাকে বেহেশত নসীব করুন।
নিপু ভাইয়ের সৃজনে–মননে চরম উৎকর্ষতা ছিল। সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অতুলনীয়, জনপ্রিয়তা ছিল অপরিমেয়, সততা ও নিষ্ঠায় অতুলনীয়। আচরণে ছিলেন অমায়িক, মিতভাষী, সদা হাসিমুখ। নম্রতা, ভদ্রতা ও বিনয় ছিল তাঁর অলংকার। বহুমুখী প্রতিভা আর বিরল গুণের চর্চা করতে করতেই তিনি হারিয়ে গেলেন। ভবিষ্যত প্রজন্মেও জন্য রেখে গেলেন ধৈর্যশীল, মহানুভব, অধ্যবসায়ী ও নিষ্ঠাবান হওয়ার মতো অনুকরণীয় আদর্শ। এমন বিরল গুণের মানুষ এ পৃথিবীতে যুগে যুগে আসেন না, মাঝে মাঝে আসেন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বেঁচে থাকেন মানুষের অন্তরে চিরকাল।
লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক; সাবেক প্রধান শিক্ষক,
কৃষ্ণকুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।