মাছে ভাতে বাঙালি একটি প্রচলিত প্রবাদ। আর সেই মাছ যদি হয় ইলিশ তাহলে তো বিষয়টা সোনায় সোহাগা। ইলিশ যেন শুধু মাছের নাম নয়, ইলিশ বাঙালির আবেগ আর ঐতিহ্যের নাম। ঐতিহ্যময় সকল উৎসবে বাঙালির পাতে ইলিশের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মত। পাতে ছোট্ট এক টুকরা ইলিশ যেন মানুষের মনের সুখের খোরাক যোগায়। শুধু বাংলাদেশের নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যান্য অনেক দেশেও সমান জনপ্রিয় আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। এই জনপ্রিয়তার কারণ কিন্তু শুধু আবেগ আর ঐতিহ্য নয়। ইলিশ মাছ খেতে যেমন মজাদার তেমনি এর পুষ্টিগুণও ওনেক বেশি। এজন্যই বলা হয় মাছের রাজা ইলিশ।
প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশ মাছে, ক্যালরি ১৬৫, প্রোটিন ২০–২৪ গ্রাম, ফ্যাট ৯–১০ গ্রাম, খাদ্য আশঁ ৩–৪ গ্রাম, শর্করা ০.৮ গ্রাম, ভিটামিন এ ৭৬ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন সি ১৪ মাইক্রোগ্রাম, ক্যালশিয়াম ৩৭০ মিলিগ্রাম, আয়রন ১৫ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৪৫ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ৯ মিলিগ্রাম, কপার ০.০৯ মিলিগ্রাম, জিংক ১.২ মিলিগ্রাম, এই পরিমাণ মাছের বয়স এবং ওজনভেদে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।
ইলিশের স্বাদ আর সুগন্ধের কারণ : ইলিশ মাছের সুস্বাদু স্বাদ এবং সুগন্ধের জন্য এর উচ্চ পরিমাণে পলিআন–স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড দায়ী। বিশেষ করে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। ইলিশ–যার মধ্যে রয়েছে স্টিয়ারিক অ্যাসিড, ওলিক অ্যাসিড, লিনোলিক অ্যাসিড, লিনোলেনিক অ্যাসিড, অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড, ইকোসাপেন্টানোয়িক এসিড, ডেকাহেক্সানোয়িক এসিড।
অ্যামিনো অ্যাসিড: ইলিশে থাকা গ্লুটামিক অ্যাসিড, অ্যালানিন এবং অ্যাসপার্টিক অ্যাসিডের মতো অ্যামিনো অ্যাসিড ইলিশের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।
উপকারিতা : ইলিশ মাছের প্রোটিন ফার্স্টক্লাস প্রোটিন। তাই শরীর গঠনের সবগুলো এসেনসিয়াল এমাইনো এসিড এখানে পাওয়া যায়। এল–আরজিনিন অ্যামাইনো অ্যাসিড শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এল–লাইসিন এমাইনো এসিড শিশুর পরিপাকতন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করে।
ইলিশের প্রোটিন কোলাজেনসমৃদ্ধ। কোলাজেন হচ্ছে অদ্রবণীয় প্রোটিন, যা কোষের ভিতরের বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনে সহায়তা করে। ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে কোলাজেন। বর্তমানে ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে কোলাজেন ব্যবহারের ব্যাপকতা অনেক বেশি।
ইলিশ মাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা–৩ এবং ওমেগা–৬ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। মানুষের শারীরতত্ত্বে তিন ধরনের ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড জড়িত–
১) ইকোস্যাপেন্টাএনোয়িক অ্যাসিড (ইপিএ), ২) ডোকোস্যাহেক্সএনোয়িক অ্যাসিড (ডিএইচএ), ৩) আলফা–লিনোলেনিক অ্যাসিড (এএলএ)। ইলিশসহ সকল সামুদ্রিক মাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা–৩ এবং ওমেগা–৬ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। যা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।
ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে হৃদরোগের ঝুকি কমায়। রক্তের খারাপ চর্বি ট্রাইগ্লিসারাইড ধমনীর অভ্যন্তরে জমে গিয়ে রক্তনালীকে সংকুচিত করে। ওমেগা–৩ ফ্যাটি এসিড রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমান কমাতে সাহায্য করে এবং ধমনীর অভ্যন্তরে ট্রাইগ্লিসারাইড জমে ব্লক তৈরী করতে বাধা প্রদান করে। এভাবেই স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে ইলিশ। ইলিশ মাছে থাকা ভিটামিন এ চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন ডি, ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাস হাড় এবং দাঁতের গঠন মজবুত করে। ইলিশ মাছের আয়রন রক্তস্বল্পতা রোধ করে এবং ভিটামিন সি আয়রনের শোষণকে তরান্বিত করে।
ইলিশের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন রাখবেন যেভাবে : সঠিক নিয়মে ইলিশ মাছ রান্না না করলে আপনি এর পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ইলিশ মাছ অতিরিক্ত ভেজে রান্না করলে ওমেগা–৩ ফ্যাটি এসিডের অপচয় হতে পারে। তাই মাছ না ভেজে বা হালকা ভেজে রান্না করতে হবে। এছাড়াই অনেক সময় ধরে রান্না করলে ভিটামিন সি, পটাশিয়ামসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হতে পারে।
ইলিশে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা এলার্জি : অনেকের ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছে এলার্জি থাকে। তাই অতিরিক্ত ইলিশ মাছ খেলে অনেকের এলার্জি হতে পারে। কারণ সামুদ্রিক মাছে হিস্টিডিন নামক এসেনসিয়াল এমাইনো এসিড থাকে। এল–হিস্টিডিন ডিকার্বোক্সিলেজ নামক এনজাইমের প্রভাবে হিস্টিডিন থেকে হিস্টামিন তৈরী হয়ে থাকে, যা অনেকের শরীরে এলার্জি জাতীয় সমস্যা তৈরী করে। কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া এই এনজাইমটি সংশ্লেষণে সহায়তা করে। পানি থেকে মাছ ডাঙায় তোলার পরে ১৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রায় মাছ থাকলে এল–হিস্টিডিন ডিকার্বোক্সিলেজ সংশ্লেষণ হতে পারে। তাই সঠিক নিয়মে ইলিশ মাছ সংরক্ষণ করতে পারলে হিস্টামিন তৈরী হতে পারে না। মাছ ধরার পর ২–৩ ঘণ্টার মধ্যে মাছকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সংরক্ষণ করতে হবে অথবা মাছ ধরার ১–২ ঘণ্টার মধ্যে রান্না করতে হবে। তাহলে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে এবং এল–হিস্টিডিন ডিকার্বোক্সিলেজ তৈরী হতে পারবে না। ফলে হিস্টামিন তৈরী হয় না এবং এলার্জি জাতীয় সমস্যাও হয় না। এছড়াও ডিপ ফ্রিজে অনেকদিন ইলিশ মাছ সংরক্ষণ করলেও একই সমস্যা হতে পারে। তাই ইলিশ মাছের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন রাখতে সঠিক উপায়ে মাছ সংরক্ষণ করতে হবে। আপনার এলার্জি প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করতেও সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা মাছ খাবেন। প্রয়োজনে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল।