একটা মানুষের চারিত্রিক মানের উচ্চ সোপান নির্ণয়ের জন্য কিছু বৈশষ্ট্য চিহ্নিত হয়। সে বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে তাঁর শিক্ষা জ্ঞান মন মনন, স্বভাব চিন্তা চেতনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা বিনয় সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গোড়ামিহীন মানবিক ধর্মীয় মূল্যবোধ। যা তাঁকে অন্য মানুষের মাঝে বিশেষ মানুষ হিসেবে দীপ্যমান করে তোলে, গড়ে তোলে অসাধারণ মানুষ হিসেবে। মাহবুব সে ধরনের একজন।
মাহবুব আমার বন্ধু ক্লাসমেট– চট্টগ্রাম কলেজে ’৬৬ থেকে ’৬৯ ’৭০ এর উত্তাল দিনে দুর্দম রাস্তায় মিছিলে, মিটিংয়ে ’৭১ এ প্রাণ বাজি রাখা সময়ে, ক্লাস রুমে, পিকনিকে আড্ডায়, রসালাপে, চটুল কথায়, অনন্য প্রগলভ জুরিহীন মাহবুব। সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি, প্রগতিশীল রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশ গঠন ও দেশের ক্রান্তিলগ্নে সদা সক্রিয় অবিচল মাহবুব। আবার এর বাইরের অপর আঙিকে মাহবুব নিশ্চল নিশ্চুপ সাথী সাজুয্যে।
আমরা তখন প্রথম বর্ষে শেষের দিকের অনার্স ক্লাসে, চট্টগ্রাম কলেজে। ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি মধ্যযুগ পড়াতেন। সে বছর স্কলারশীপ নিয়ে ইংল্যান্ড যাচ্ছিলেন ডক্টরেট করবেন। ক্লাসে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে হঠাৎ করে মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্যের উপর একটা প্রশ্ন করে বসলেন। আমার মতো মধ্যমানের– শওকত আমিরুজ্জামান, বীরেশ, বীরেন, হানিফ, গোপা, স্বস্তিকা, মাহবুবা, জেবু, নূর নাহার যেমন চুপ, ঠিক তেমনি মাহবুব, শ্রিপ্রা, কাসেম, আজিজও চুপ। একে অপরের দিকে দেখছিলাম। আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু পর স্মিত হাসিতে বললেন– ‘আমি বুঝতে পেরেছি– ঠিক আছে– দেখবে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু মাহবুবদের কাছে প্রশ্নের উত্তর কি অজানা ছিলো? আবার দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে প্রায় দেড় বছর পর ছুটিতে এসে ক্লাস নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে মধ্যযুগের কোন একটা কাব্য গ্রন্থের উপর এবারও প্রশ্ন করে বসলেন, একই অবস্থা আমাদের সবার যেন। এবারও হেসে বলেন– “তোমাদের মন খারাপ করার কোন কারণ নেই, দেখবে তৃতীয় বর্ষে উঠলে সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু আসলে কী আমরা সবাই বুঝিনি? স্যারের কথামতো তৃতীয় বর্ষে উঠার পর কেমন জানি প্রত্যেকটা পেপারের উপর একটা মাস্টারী চলে আসলো, সবই যেন পরিষ্কার আমার মতো অন্য সবারও রেজাল্ট ভালো হলো।
ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলছিলো ফাইনাল ইয়ার মাস্টার্সে এসে এম এ ফার্স্ট পার্ট এর সবাই সহ প্রায় ষাট জনের মতো। তার মধ্যে মনে পড়ছে ইব্রাহিম, ফারুখ, আলিম, গোলাম রাব্বান, আশরাফ, নীলা, মালেকা, সীতার কথা। প্রচণ্ড রাসভারী, দেশজুড়ে খ্যাতিমান বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান স্যার আমাদের জীবনের শেষ ক্লাশ নিচ্ছিলেন– রবীন্দ্রনাথ পড়াতেন। পড়িয়েছেন আট নয় মাস অনেকটাই যেন জানা হয়ে গিয়েছিল। এরপরও জীবনের শেষ ক্লাসে কি একটা প্রশ্ন করে বসলেন– সবাই চুপ, কোন উত্তর ছাড়া। মিনিট খানেক পার হতেই একটু উষ্মার সাথেই স্মিত হাসিতে বললেন– বাচ্ বিচার না করে আমপাতা, জামপাতা, সবই খাও। ঠিক আছে সবাই ভালো করো, ভালো থেকো। আসলে আমরাতো ভাগ্যবানই, না হয় এ ধরনের শিক্ষকদের পাই? আর মাহবুবদের কথাত আলাদাই– কিন্তু তারাও চুপ ছিল কী সতীর্থদের প্রতি হৃদতার প্রতীক হয়ে?
এ সমস্ত কিছু আসলে ‘ধান ভান্্তে শিবের গীত নয়’। সবাইত অত্যন্ত কঠিন ইন্টারভিউ পেরিয়ে চান্স পাওয়া। তাই বুঝি স্যারদের এতো স্নেহ এতো আস্থা বিশ্বাস– এরপর মাহবুবরা আলাদা। বন্ধুত্ব হৃদ্যতা সবকিছুর উপরে। আর আজ সেই অনার্স, এম এ ক্লাস গ্রামের প্রাইভেট/সরকারি কলেজেও চলছে, জানিনা কী হবে?
ড. মাহবুব একজন গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, বাংলা বানানরীতি বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক। বিশেষত লোকসাহিত্য, লোক সংস্কৃতি ও লোক ভাষা তথা ফরিদপুরের মানুষ হয়েও আবাসস্থল চট্টগ্রামের ভষার রূপ বিন্যাসে রূপ পরিচয়ে কাজ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অবস্থান চাটগাঁ ভাষা পরিষদ প্রকাশিত পুস্তকে তুলে ধরে– দ্বৈর্থহীনভাবে প্রকাশ করেছেন “মধ্যযুগে চাটগাঁয় সব চাইতে বেশি ও ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হয়েছে। তাদের রচনায় খুঁজলে এই অঞ্চলের শব্দ, শব্দবন্ধ এবং বানান রীতি হয়তো যথেষ্টই পাওয়া যাবে।… চট্টগ্রামের সকল কাব্যধারা পরীক্ষা করেও দেখতে পাই, চট্টগ্রামের কাব্য বিষয়ও ধারা নিখিল বঙ্গীয় বাংলা সাহিত্যের কাব্যধারারই সমান্তরাল.. কৃত্তিবাসের রচনার সঙ্গে সঞ্জয়ের ভাষার, মুকুন্দরামের ভাষার সঙ্গে দৌলত কাজীর…ভারতচন্দ্রের সঙ্গে আলাওলের ভাষার তেমন পার্থক্য কোথায়?”
ড. মাহবুবুল হকের প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা চল্লিশ ছাড়িয়ে। কঠিন বিষয়াবলী নিয়ে কাজ করা তাঁর স্বভাব যেন অনেকটা চ্যালেঞ্জ সামলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। চাটগাঁ ভাষার উপর শিমুল বড়ুয়াকে নিয়ে কাজটি যেমন সম্পাদনা করেছেন ঠিক তেমনভাবে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত দুই বাংলার প্রথম সমন্বিত ব্যাকরণ ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ এর তিনি সহযোগী সম্পাদক ও লেখক। বাংলা ভাষার শব্দ প্রকরণ, ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, বাংলা অক্ষরসমূহের ব্যাকরণগত বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত আয়োজন প্রমিত বাংলা এবং এর রূপ পরিচয়ে জাতীয় শিক্ষা জীবনে প্রগাঢ় ভূমিকা রেখেছে। তাঁর লেখা শিশুতোষ ছড়া, কবিতা, পাঠ্যপুস্তকে প্রকাশিত লেখাসমূহ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা পাঠ্যক্রম প্রণয়নকারীদের আহ্বায়ক হিসেবে তাঁর অসামান্য ভূমিকা দেশ মনে রাখবে।
মাহবুব প্রকাশিত পুস্তকগুলোর মধ্যে ২৫টির মতো পুস্তক অনুবাদ, সম্পাদনা ও পাঠ্যপুস্তক যা শুধু দেশে নয় বিদেশেও তাঁর পরিচিতি তুলে ধরেছে। তার সৃষ্টি বৈচিত্র্য, কঠিন বিষয়াবলীর সহজ সরল উপস্থাপনা, নিবিড় অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ফোকলোর ও সমকালীন সাহিত্য, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নির্ণয় ও পরম্পরা নির্ণয়ের রূপ পরিসরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, কল্যাণী ও পাতিয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠের মর্যাদা প্রাপ্ত হন। তার কিছু কিছু গ্রন্থ ভারত ও তদানীন্তন রাশিয়া থেকেও প্রকাশিত।
মাহবুবুল হকের প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য –মাক্সিম গোর্কীর মা, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বাংলা বানানের নিয়ম, বিশ্ব তারিখ অভিধান, তিনজন আধুনিক কবি–সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য গবেষণা পুস্তক– বাংলা সাহিত্যের নানা নিবন্ধ, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ, নজরুল তারিখ অভিধান (গবেষণাপত্র), বাংলার লোক সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ, লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য, বাংলা কথাসাহিত্য, চট্টগ্রামে শেখ মুজিব, বাংলা কথা সাহিত্য রঙে ও রেখায়, চট্টগ্রামী সহজ পাঠ প্রভৃতি। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য –গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলন, ভাষার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বীরশ্রেষ্ঠদের কথা, ছড়ায় ছড়ায় বাংলা বানান, গল্পে গল্পে নজরুল, জল পড়ে পাতা নড়ে প্রভৃতি।
উপরোক্ত কর্ম ও সাহিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ড. মাহবুব পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যে একুশে পদক, প্রবন্ধে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রশিদ আল ফারুকী পদক, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরস্কার, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা, কবি মধুসুধন পুরস্কার।
বৃহত্তর ফরিদপুরে মুধুখালী উপজেলায় ৩ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া মাহবুব চট্টগ্রামে পিতার রেলওয়েতে চাকুরির সূত্রে বেড়ে উঠেছেন বাগমনিরামের বাঘঘোনা এলাকায় বাগমনিরাম স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষায়, কলেজিয়েট স্কুলে কবিতা লেখার সূত্রপাতে স্কুল বার্ষিকী সম্পাদনায়, চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা বিভাগে সাহিত্য চর্চা শুরু হয় কলরোল দিয়ে কলেজ বার্ষিকী ‘অন্বেষা’ সম্পাদনা এরপর ইতিহাস সৃষ্টির মাধ্যমে আবার চট্টগ্রামেই আজকে এই আকাশ তলেই সম্পাদনায় তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে প্রীত যেন মাহবুব। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ ও কিডনী রোগে ভুগে ২৪ জুলাই ২০২৪ ইন্তিকাল করেন। কিন্তু তার গবেষণা, কর্ম ও সৃষ্টি তাঁকে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে। তথ্যসূত্র: স্মরণ গ্রন্থাবলি ও ব্যক্তিগত স্মৃতি
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক