মাঝখানে পড়াশোনায় বেশ অনিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ব্যস্ততা একটু ছিল বটে। তবে সে ব্যস্ততার ভার এতো ভারি নয় যে তার কারণে পড়ার–অনিয়মটাকে হালকা করে দেখা যেতে পারে। আর আমার চিরকালের অনিয়মটাই যে আমার নিয়মে গিয়ে ঠেকেছে সে আমাকে যারা চেনে বা জানে তাদের বেশ জানা। অনিয়মকে পাশে রেখে সপ্তাহ কয়েক ধরে নতুন উদ্যোমে পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি। তার শুরু দেরি করে সারা ব্রেকফাস্ট শেষে। বিশেষ করে দিনের বেলা রৌদ্রের দেখা মিললে ব্যাক–ইয়ার্ডে যে ছোট্ট বাগান তাতে একখানা চেয়ার টেনে সূর্যকে পিঠ দিয়ে কোলের উপর বই মেলে ধরি। অতিথিদের বসার কামরা যাকে আমরা ড্রয়িংরুম বলি সেখানে এবং তেতলার ছোট্ট কামরায় যে কটি বইয়ের আলমারি সেখানকার অনেকগুলি বই এখনো না–পড়ার তালিকায় রয়ে গেছে। দেশে গেলে ফেরার সময় আমাদের অনেকেই নানা ধরনের জিনিসপত্র, কাপড়–চোপড়, খাবার ইত্যাদি কেনাকাটা করে নিয়ে আসে। আমার কেবল বই। এই নিয়ে এক সময় ঘরের–জনের অভিযোগের অন্ত ছিল না। লাগেজের যে স্পেস তার সিংহভাগ যায় তার নিজের এবং অন্যদের জন্যে কেনাকাটা জিনিসপত্র, উপহার সামগ্রীতে। আমার যৎসামান্য বই। তাতেও তার মৃদু আপত্তি। তবে সে আপত্তির উত্তাপ এখন কমে এসেছে। আমার অতি ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধু কিছুদিন আগে বেশ দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন, ‘বাসা বদল করতে গিয়ে দেখি স্ত্রী পুরানো দিনের বই, পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা সব ‘সের দরে’ শিশি–বোতলওয়ালার কাছে আমার অজান্তে বিক্রি করে দিয়েছে।’ দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে আমাদের অনেকের কাছে বই হচ্ছে কেবল পরীক্ষায় ‘পাশ’ দেবার জন্যে। নিদেনপক্ষে ড্রয়িংরুমের শো–কেইজে রাখার জন্যে। এর বাইরে বইয়ের আর কোন ব্যবহার আছে বলে তারা মনে করেননা। অনেককে দেখেছি আপনজনকে নিয়ে বই মেলায় নিয়ে গিয়ে মুখরোচক খাবার খেয়ে ‘মজা‘ ও ‘ফূর্তি’ করে ফিরে আসতে। বই কেনা তাদের আর হয় না। বই তাদের কাছে খুব একটা প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ বইয়ের মত নিত্যসঙ্গী আর কিছু হতে পারে না। ওমর খৈয়াম তো বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ বই হচ্ছে সেরা আপনজন, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না, কোনোদিন মনোমালিন্য হয়না। সৈয়দ মুজতবা আলীর কথায়– ‘বই কিনে কেউ কোনদিন দেউলিয়া হয় না।’ শিশুদের এই বই উপহার দেয়া নিয়ে যুদ্ধ করেছি অনেক। খুব কম ক্ষেত্রেই সফল হয়েছি। এখানে আমাদের বাঙালি গোষ্ঠীর মাঝে প্রায় প্রতি সপ্তাহে কারো না কারো বাসায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। আয়োজন করা হয় বিশাল ভোজের, সাথে কখনো সখনো নাচ গান, ফানও। আমন্ত্রিত অতিথিরা নিয়ে আসেন উপহার সামগ্রী, বলা বাহুল্য দামি। লক্ষ্যণীয়, এদের অনেকের মাঝে থাকে এক ধরনের অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। কে কার চাইতে বেশি দামি উপহার দিতে পারেন তার অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। তাতে নাকি তার বা তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ভাবি সামাজিক মর্যাদা কত সস্তা ও সহজলভ্য! এই সমস্ত অনুষ্ঠানে, এমন কী শিশুদের জন্মদিনের পার্টি হলেও খুব কম দেখেছি শিশুদের বই উপহার দিতে। সবাই দিচ্ছেন দামি দামি উপহার, খেলনা সামগ্রী। বই কদাচিৎ। এই নিয়ে কারো কারো বিরাগভাজন হয়ে অনেক বলে–কয়েও এই দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন করতে না পেরে অনেক দিন থেকে বলা ক্ষান্ত দিয়েছি। মনে হয়েছে আমার এই ব্যর্থ প্রচেষ্টা অনেকটা ‘উলু বনে মুক্ত ছড়ানোর মতো’। আমার একটি ভালো লাগা এই যে বই কিনে পড়ার অভ্যেসটা আমার আত্মজা, সপ্তর্ষির মাঝে প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছি। সন্তানদের উৎসাহিত করতে হবে এই ব্যাপারে। বিল গেইটস একবার বলেছিলেন, ‘খুব কম বয়সেই বই পড়ার প্রতি আমার ঝোঁক তৈরি হয়। শিশু হিসেবে বাবা–মাও বই কিনতে আমাকে ইচ্ছা মতোই টাকা দিতেন। তাই আমি প্রচুর পড়তাম।‘ অনেকে মনে করেন, টাকা নষ্ট। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না।‘
২) বছর খানেক আগে শম্পা তার ৪৪টি বই দিয়ে গেছে। শম্পা ও তার স্বামী নীল আমাদের পারিবারিক বন্ধু। ওদের এক ছেলে। বয়স ৪/৫। শম্পার ‘বেবি শাওয়ার‘ অনুষ্ঠান বেশ ঘটা করে সুমনা আমাদের বাসায় আয়োজন করেছিল। সে নুতন চাকরি নিয়ে যোগ দিয়েছে ঢাকায় ডাচ দূতাবাসে। সঙ্গী হয়েছে তার ডাচ স্বামী বন্ধুসম, নীল। পুরো নাম নীল ফান দেন বের্গ। দুবার স্বল্প সময়ের জন্যে সে ডাচ পার্লামেন্টের সদস্য ছিল। বাঙালি না হয়েও বাঙালিপনার অভাব নেই তার মাঝে। আমাদের সাথেও চেষ্টা করে বাংলা বলতে। একসময় বছর কয়েক ঢাকায় কাজ করেছে। বিটিভিতে হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি‘ অনুষ্ঠানে একটি পর্বে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকদের নিয়ে একটি ছোট্ট নাটিকা দেখানো হতো। তাতে নীল বেশ কয়েকবার অংশ নিয়েছিল। ভল্টান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) নামে একটি আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থার পক্ষ থেকে সে বাংলাদেশে গিয়েছিল কাজ করতে। সে আজ থেকে কম করে দশ বার বছর আগেকার কথা। ভিএসও প্রতি বছর বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলিতে এই ধরণের ভলান্টিয়ার পাঠায়। সেখানে এরা গিয়ে সেদেশের নানা উন্নয়নমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করে। তখন আমার উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম নভিবের সাথে কাজের সূত্রে যোগাযোগ ছিল। ভিএসও থেকে আমন্ত্রণ এলো দূরের এক শহরে এক দল বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশের জীবনযাত্রা, আবহাওয়া, নিরাপত্তা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে লেকচার দেবার জন্যে। সেই থেকে নীলের সাথে পরিচয় এবং যোগাযোগ। দেশে থাকাকালীন শম্পার সাথে নীলের পরিচয়, প্রেম এবং পরিণয়ে সমাপ্তি। ডাচ বা ইংরেজি ভাষা হলে হয়তো কোন সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসপত্রের দোকানে দিতে পারতো। কিন্তু বইগুলি কয়েকটি বাদে সব বাংলায়। বইগুলির যথাযথ ব্যবহার হবে এই বিশ্বাসে আমার অবর্তমানে শম্পা সুমনার হাতে বইগুলি গছিয়ে দিয়েছিল। আমি তখন দেশে। ফিরে এসে যখন দেখলাম তখন কী ভালো লেগেছিল সে বলে–কয়ে শেষ করা যাবেনা। সেখান থেকে ইতিমধ্যে কয়েকখানা পড়া হয়েছে।
৩) একটা সময় ছিল যখন বই–পড়া ছিল অনেকটা নেশার মত। স্কুল–বয়স থেকে এই নেশায় পেয়ে বসেছিল। বাসা থেকে অনতিদূরে ছিল স্কুল। হেঁটে পৌঁছুতে বড় জোর মিনিট দশ/বার। বটতলী রেলওয়ে স্টেশনের (বর্তমানে পুরানো রেলস্টেশন) পাশ দিয়ে একটি পথচারী পারাপারের ওভারহেড ব্রীজ ছিল। সম্ভবত এখনো সেটি আছে। সেটি পেরুলেই রেলওয়ে কলোনি। তারপর রাস্তা পেরুলে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে তড়িঘড়ি করে দুটো ভাত মুখে দিয়ে হেঁটে রওনা দিতাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের উদ্দেশ্যে। মাঝখানে বড়সড় হল, তার দু–পাশে দুটি বড় আকারের লাইব্রেরি। ঢুকতে ডানদিকে পাবলিক লাইব্রেরি, বাঁয়ে পাকিস্তান কাউন্সিল। বাসা থেকে দূরত্ব একেবারে কম ছিলনা। স্কুলের পড়াশোনা, বিকেলে খেলাধুলা, খেলার মাঠ থেকে গায়ের ঘাম নিয়ে সরাসরি বাসায় গৃহ শিক্ষকের সামনে উপস্থিত হওয়া– এই ছিল অনেকটা নিত্য রুটিন। এখন ভেবে অবাক হই এতো সব ব্যস্ততার মাঝেও কী করে লাইব্রেরি যাবার সময় বের করে নিতাম! এতো উৎসাহ, শক্তিই বা কোথা থেকে পেতাম! ছিলাম তালপাতার সেপাই। যে–বয়সে বঙ্কিম, তারাশঙ্কর, যাযাবর বুঝে উঠার কথা না, সে বয়সে পড়েছি ওদের লেখা অনেক বই। তারও আগে শুরুতে টানটান উত্তেজনা নিয়ে দস্যু বনহুর, দুস্য বাহরাম সিরিজ পড়তাম। এরপর শরৎচন্দ্র, শংকর, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, তারাশংকর – মোটকথা হাতের কাছে যা পেয়েছি তা পড়েছি। একটা সময় পাবলিক লাইব্রেরির প্রায় সব বাংলা গল্প বই পড়া শেষ হলে, শুরু করলাম পাকিস্তান কাউন্সিল লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়া। তবে বলতেই হয় পাবলিক লাইব্রেরির বইয়ের কালেকশন ও পরিবেশ ছিল পাকিস্তান কাউন্সিল থেকে অনেক ‘রিচ‘। কিন্তু কয়েক ঘন্টায় তো আর একটি বই সম্পূর্ণ শেষ করা সম্ভব হতোনা। রেখে আসতাম অন্য কোন ‘তাকে‘, বইয়ের ফাঁকে যেখানে রিসার্চ জাতীয় বই থাকতো। পরদিন এসে আধখানা–পড়া বইটি বের করে শেষ করতাম। কিন্তু এতদূর হেঁটে গিয়ে বই পড়তে যাওয়া– তার জন্যে কোনদিন ঘুণাক্ষরেও কোন আলসেমী বা কষ্ট লাগেনি। বরঞ্চ যেতে না পারলে যেন পেটের ভাত হজম হতোনা। পাঠ্য বইয়ের নিচে রেখে কত যে ‘বাইরের–বই‘ পড়েছি তার শেষ নেই। মা মাঝে মধ্যে এসে দেখতেন পাঠ্য বই পড়ছি না অন্য কিছু। কখনো ধরা পড়িনি, তবে মনে হতো তাকে যে ফাঁকি দিচ্ছি সে উনি টের পেতেন। তাকে ফাঁকি দেয়ার মধ্যে দিয়ে যে নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি সে বোধটুকু তখন হয়নি।
৪) জীবনে খুব একটা পুরস্কার পাইনি। সে যোগ্যতা বোধকরি ছিলনা। তবে একবার স্কুল–বয়সে, খুব সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ছি, স্কুলের বার্ষিক প্রতিযোগিতায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উপর রচনা লিখে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। প্রথম হয়েছিল আমার দুই ক্লাস উপরের এক অতি সুন্দরী মেয়ে, নাম সেলিনা। পুরস্কার হিসাবে মহাপুরুষের জীবনী নিয়ে একটি ছোট্ট বই পাই। সেটি অতি যত্ন সহকারে রেখেছিলাম। চাকরি নিয়ে ঢাকা চলে আসার আগ পর্যন্ত বইটি ছিল আমার দখলে থাকা একটি ছোট্ট আলমিরাতে। এরপর কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। জীবনে পাওয়া প্রথম পুরস্কার হারিয়ে গেল। জীবনের কত কিছুই তো এমনি করে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়। যখন হারিয়ে যায় তখন বুঝি টের পাইনে কী হারালাম। কিন্তু জীবনের একটা সময় এসে যখন হারিয়ে যাওয়া প্রিয় জিনিস কিংবা হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা মনে করি তখন উপলদ্ধি করি কী হারালাম। মনটা সাথে সাথে চোখ দুটো কিছুটা ভিজে আসে। (১৪–০৮–২০২৫)।
লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।