চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ জুড়ে ৭২টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৬টি পুরোপুরি অরক্ষিত। দেশের প্রধান পর্যটন শহর কক্সবাজার রুটের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি রেলপথে এতগুলো লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান না থাকায় ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। ছোট–বড় দুর্ঘটনা ঘটছে প্রায় সময়। এই দীর্ঘ রেলপথে মাত্র ১৬টি ক্রসিংয়ে গেট বা গেটম্যান আছেন বলে জানান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দোহাজারী–কক্সবাজার রেলপথের আনুষ্ঠানিক যাত্রার পৌনে দুই বছরের মাথায় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, যার জন্য মূলত অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংকেই দায়ী করা হচ্ছে। গত এক বছরেই চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে গেটম্যান বিহীন অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ১৭ জনের। এ ছাড়াও ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার।
২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বহুল প্রতীক্ষিত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইনটি উদ্বোধন করা হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ঢাকা–কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। এরপর থেকেই দেশের মানুষের কাছে দিনদিন ট্রেনে করে দেশের প্রধান পর্যটন নগরী কক্সবাজার ভ্রমণের আকর্ষণ বাড়ছে। রেলওয়ের পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগ থেকে খবর নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন চালু হওয়ার পর থেকে অর্থবছরে (গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত) ঢাকা–কক্সবাজার রুটে চলাচলরত দুই জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন এবং চট্টগ্রাম–কক্সবাজার দুই জোড়াসহ চলাচলরত চার জোড়া ট্রেন থেকে প্রায় শত কোটি টাকার কাছাকাছি রাজস্ব আয় হয়েছে।
অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথের আনুষ্ঠানিক যাত্রার পৌনে দুই বছরের মাথায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, যার জন্য মূলত অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংকেই দায়ী করা হচ্ছে। সবশেষ গত ১ আগস্ট কক্সবাজারের রামু উপজেলার রশিদনগর এলাকায় একটি অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং (যেখানে কোনো গেটম্যান নেই) পার হওয়ার সময় কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী ট্রেনের ধাক্কায় একটি সিএনজি টেক্সি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে সিএনজি চালকসহ চার যাত্রী নিহত হন।
রামু রশিদনগর এলাকার বাসিন্দা আবুল মকসুদ জানান, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেলক্রসিং। অথচ রেলওয়ে এখানে কোনো গেটম্যান বা সিগন্যালের ব্যবস্থা করেনি। প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় এই এলাকার শতশত মানুষকে। এই কারণে এই ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ইসলামাবাদ–রামু সেকশন, যেখানে ১৭টি ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র একটিতে গেটম্যান রয়েছে। এছাড়া চকরিয়া, ডুলাহাজারা, হারবাং ও লোহাগাড়ার বিভিন্ন সেকশনেও একই চিত্র। বেশ কিছু অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ‘এই গেটে কোনো গেটম্যান নেই, নিজ দায়িত্বে পারাপার করুন’ লেখা সাইনবোর্ড থাকলেও তা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো কাজে আসছে না বলে জানান স্থানীয়রা।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দোহাজারী–কক্সবাজার রেলপথটি এখনো প্রকল্পের অধীনে রয়েছে। প্রকল্প থেকে এখনো রেলওয়েকে হস্তান্তর করা হয়নি। যার কারণে রেলওয়ে চাইলেও এখানে নিজেদের মত করে কোনো কাজ করতে পারছে না। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত রয়েছে।
পূর্বাঞ্চলের পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এই প্রকল্পের জন্য স্থায়ী জনবল নিয়োগ এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়নি। তাই প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ীভাবে কিছু গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হলেও গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথে তা একেবারেই অপ্রতুল।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেললাইনের প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সবুক্তগীন বলেন, দোহাজারী–কক্সবাজার রেলপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে ইতোমধ্যে ৪৬টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে রেলপথের দুইপাশের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বেশি প্রয়োজন। আমাদের পক্ষ থেকে এলাকার লোকজনের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কক্সবাজার রেলপথে সব লেভেল ক্রসিংই অনুমোদিত। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোতেও গেটম্যান নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।