চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চলে এখন পেয়ারা আর পেয়ারা

এক মৌসুমেই বিক্রি শত কোটি টাকা

মুহাম্মদ এরশাদ, চন্দনাইশ | শনিবার , ১৬ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

চন্দনাইশে এক মৌসুমেই বিক্রি হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকার পেয়ারা। প্রতি বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পুরো তিন মাসজুড়ে বিক্রি হয় চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত এসব সুস্বাদু পেয়ারা। বরাবরের মতো চলতি মৌসুমেও পেয়ারার উৎপাদন ভালো হয়েছে। বাজারে প্রচুর পেয়ারা আসছে। চলতি মৌসুমে পেয়ারার দামও বেশি বলে জানালেন বাগানিরা। প্রতি দুই পুটলি (৭০ থেকে ৮০ কেজি) পেয়ারার দাম পড়ছে গড়ে ৩ হাজার টাকার উপরে। চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চলের পেয়ারা বাগানগুলোতে এখন পেয়ারা আর পেয়ারা। শত শত বাগানিরা রাতেই শ্রমিক নিয়ে চলে যান বাগানে। বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে ভোরের আলো ফুটতেই শত শত পেয়ারা শ্রমিক কাঁধে বহন করে নিয়ে আসেন লোকালয়ে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরাসরি পেয়ারা বাগানিদের কাছ থেকে পেয়ারা কিনে নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যান। কোনো ধরনের ক্ষতিকারক কিটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই পেয়ারা উৎপাদন হওয়ায় অর্গানিক পেয়ারা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এখানকার পেয়ারা। দেশ ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে চন্দনাইশের পেয়ারার।

জানা যায়, উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল কাঞ্চননগর, হাশিমপুর, দোহাজারী, ধোপাছড়ি এখন পেয়ারা গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে কাঞ্চননগর এলাকায় সর্বাধিক পেয়ারা উৎপাদন হওয়ায় এখানকার পেয়ারার নামকরণও হয়ে গেছে ‘কাঞ্চন পেয়ারা’ হিসেবে। পেয়ারা বাগান করে কয়েক হাজার মানুষ তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নিয়েছেন। শত শত বেকার যুবক পেয়ারা ব্যবসায় জড়িয়ে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের হাল ধরেছেন। পাশাপাশি পেয়ারা সংগ্রহ, পরিবহনেও কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেকেই পেয়ারা চাষে শূন্য থেকে পরিণত হয়েছে লাখপতিতে। চলতি মৌসুমে ৭২০ হেক্টর পাহাড়ি ভূমিতে পেয়ারার চাষ হয়েছে বলে উপজেলা অফিস সূত্রে জানা যায়। প্রতি হেক্টরে ১৫ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি পেয়ারা ১০০ টাকা হিসেবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৮ কোটি টাকা। যদিও এখানকার পেয়ারা ডজন হিসেবে বিক্রি করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রতি মৌসুমে চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চলে কমপক্ষে ২ হাজার বাগানে পেয়ারা চাষ হয়। এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা সাইজে বড়, দেখতে সুন্দর, খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় দেশব্যাপী প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফলে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা ফাঁড়িয়ারা দূরদূরান্ত থেকে এসে ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করেন। তাছাড়া চাহিদার কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বর্তমানে সামান্য সংখ্যক পেয়ারা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বলে জানান পেয়ারা চাষের সাথে সংশ্লিষ্টরা।

সাইজ অনুযায়ী বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি ডজন পেয়ারা ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রামকঙবাজার মহাসড়কের রওশন হাটের বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রতিদিন ভোরে বসে পেয়ারার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। লাল কাপড়ে মোড়ানো ২ পুটলি (এক ভার) পেয়ারা বর্তমানে ৩ হাজার টাকা বিক্রি হয়। রাতে পেয়ারা সংগ্রহ করে ভোরের আলো ফুটতেই শত শত শ্রমিক কাঁধে বহন করে ৭/৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভার নিয়ে আসেন মহাসড়ক সংলগ্ন কয়েকটি অস্থায়ী বাজারে। এখান থেকে ফাঁড়িয়ারা পেয়ারা কিনে ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে সরবরাহ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। আবার কাঞ্চননগর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত শত শত কিশোর ও যুবক পেয়ারা নিয়ে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মহাসড়কে চলাচলরত বিলাসবহুল গাড়ির যাত্রীদের কাছে ডজন হিসেবেও খুচরা বিক্রি করে। মহাসড়কে যাতায়ত করার সময় দেখা যায় এমন চিত্র।

চন্দনাইশের ছৈয়দাবাদ এলাকার পেয়ারা বাগানি আবদুল আলীম মেম্বার জানান, এ অঞ্চলটি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় কোনো ধরনের যত্নআত্তি ছাড়াই এখানে পেয়ারার প্রচুর উৎপাদন হয়। এখানকার পেয়ারা সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় সারাদেশে এর চাহিদা রয়েছে। তিনি চলতি মৌসুমে ১০ কানি পরিমাণ বাগান তিন মাস পর্যন্ত পেয়ারা বিক্রির চুক্তি করেছেন ১ লাখ টাকায়। আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সুদমুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হলে এ অঞ্চলে শুধুমাত্র পেয়ারা চাষ করেই দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা পাইকারি হারে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হলে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদন হওয়া সরকারি এসব পাহাড়গুলো চাষিরা যাতে স্থায়ী বন্দোবস্ত পায় সে দাবি জানিয়েছেন অনেকেই।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মানেশ দে ও নিউটন দে জানান, চলতি মৌসুমে চন্দনাইশের বিভিন্ন পাহাড়ে ৭২০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়েছে। এখন চলছে পেয়ারার ভরা মৌসুম। চন্দনাইশে উৎপাদিত পেয়ারা প্রতি মৌসুমের জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে বিক্রি শুরু হয়ে চলে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এখানকার পেয়ারা বাগানিদের প্রয়োজনীয় মুহুর্তে নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করা হয়, যাতে পেয়ারা বাগানিরা ক্ষতির সম্মুখীন না হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনে আজ থেকে তেল যাবে ঢাকায়
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিদিন জমে ৫০ টন ময়লা,দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ পথচারীরা