প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর রাসুলুল্লাহর (সা.)-প্রয়োজনীয় আমল

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ১৫ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

মুমিনের প্রতিটি কাজমুহূর্ত আমল ও ইবাদত। অন্য সবকিছুর মতো প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর রাসুল (সা.)-বিভিন্ন দোয়া ও আমল করতেন। সাহাবায়ে কেরামকেও তা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে নির্দেশও দিতেন। আমলগুলো করলে বান্দার জীবন সুন্দর, বরকতময় ও সুশৃঙ্খল হয়। ফরজ নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং মুমিনের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মহানবী (সা.)-ফরজ নামাজের পর নির্দিষ্ট কিছু আমল করতেন যা তাঁর সুন্নাহর অংশ। এই আমলগুলো নামাজের সওয়াবকে পূর্ণতা দেয় আধ্যাত্মিক সংযোগ বাড়ায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়তা করে। ফরজ নামাজের পর নবীজি (সা.)-এর আমল ও তার ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

. নির্দিষ্ট তসবিহ পাঠ : তিনি ফরজ নামাজের পর নির্দিষ্ট তসবিহ পাঠ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.)-থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে নবীজি (সা.)-বলেছেন যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এবং ৩৩ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে, তারপর একবার ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লিা্লশাইইন কাদির’ বলে তার গুনাহ সমুদ্রের ফেনার চেয়ে বেশি হলেও মাফ করে দেওয়া হবে।

. আয়াতুল কুরসি পাঠ : ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি (সুরা বাকারা : আয়াত : ২৫৫) পাঠ করা নবীজি (সা.) এর সুন্নাহ। আবু উমামা (রা.)-থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে নবীজি (সা.)-বলেছেন যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পড়ে তার জন্য মৃত্যু ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করার আর কিছুই বাধা হবে না।

. সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ : নবীজি (সা.)-ফজর ও মাগরিব নামাজের পর সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক এবং সুরা নাস তিনবার করে পড়তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে খুবাইব (রা.)-থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে নবীজি (সা.)-বলেছেন প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস তিনবার পড়ো এটি তোমাদের জন্য সব ধরনের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা দেবে।

. দোয়া ও মুনাজাত : নবীজি (সা.)-ফরজ নামাজের পর দোয়া করতেন। উকবা ইবনে আমির (রা.)-থেকে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.)-বলেছেন প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর দোয়া করা কবুল হয়। সাধারণত তিনি এই সময়ে নিজের জন্য পরিবারের জন্য এবং উম্মাহর জন্য দোয়া করতেন। একটি সাধারণ দোয়া হলো : উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু ওয়া মিনকাস সালাম তাবারাকতা ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম। অর্থ : হে আল্লাহ তুমি শান্তির উৎস এবং তোমার কাছ থেকে শান্তি আসে, তুমি মহিমান্বিত, হে মহত্ত্ব ও সম্মানের অধিকারী।

. নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে জিকির : নবীজি (সা.)-ফরজ নামাজের পর নামাজের স্থানে বসে জিকির করতেন। আয়েশা (রা.)-থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে নবীজি (সা.)-ফরজ নামাজের পর তাঁর স্থানে বসে জিকির করতেন এবং সালাম ফিরিয়ে ডান দিকে মুখ করতেন।

. সুন্নত নামাজ : তিন ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর নবীজি (সা.)-সুন্নাত নামাজ পড়তেন। জোহরের পর : ২ রাকাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, মাগরিবের পর : ২ রাকাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং ইশার পর : ২ রাকাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।

আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দোয়া : হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.)বলেছেন যে ব্যক্তি সকালসন্ধ্যা তিনবার নিম্নের দোয়া পাঠ করবে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সন্তুষ্ট করবেন। দোয়াটি হলো : রাজিতু বিল্লাহি রব্বাও ওয়াবিল ইসলামি দ্বীনাও ওয়াবি মুহাম্মাদিন নাবিয়্যা। অর্থ : আমি আল্লাহকে রব হিসেবে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে ও মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।

জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া : হাদিসে এসেছে যে ব্যক্তি ফজর ও মাগরিবের পর সাতবার নিম্নের দোয়াটি পাঠ করে এবং ওই দিনে বা রাতে তার মৃত্যু হয় তাহলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান্নার। অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করুন।

সাইয়্যিদুল ইসতেগফার : আল্লাহর রাসুল (সা.)হাদিসে উল্লেখ করেছেন যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকালসন্ধ্যা নিম্নের ইসতেগফারটি পড়ে এবং ওই দিনে বা রাতে ইন্তেকাল করে তবে সে জান্নাতি হবে। উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আন্তা খালাকতানি ওয়া আনা আব্দুকা ওয়া আনা আলা আহিদকা ওয়া ওয়াদিকা মাস্তাতাতু আউজু বিকা মিন শাররি মা সানাতু আবুউ লাকা বিনিমাতিকা আলাইয়্যা ওয়া আবুউ বিজাম্বি ফাগফিরলী ফাইন্নাহু লা ইয়াগিফরুজ জুনুবা ইল্লা আন্তা।

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমি আপনার গোলাম। আমি আপনার ওয়াদাপ্রতিশ্রুতির ওপর যথাসাধ্য আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। আমি আমার ওপর আপনার অনুগ্রহ স্বীকার করছি। আবার আমার গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। কেননা আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহগুলো ক্ষমা করতে পারবে না।

ফজরের নামাজের পর লম্বা সময় নামাজের স্থানে বসেছিলেন উম্মুল মুমিনিন হজরত জুওয়ায়বিয়া প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সঙ্গে কথা বললেন এবং সকালবেলার সর্বোত্তম জিকির সম্পর্কে তাকে জানালেন। হাদিসটি তিনি এভাবে বর্ণনা করেনউম্মুল মুমিনিন হজরত জুওয়ায়রিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যূষে (ফজরের নামাজ শেষ করে) তাঁর কাছ থেকে বের হলেন। যখন তিনি ফজরের নামাজ আদায় করলেন তখন তিনি নামাজের জায়গায় ছিলেন। এরপর তিনি দোহার পরে (সূর্য ওঠার বেশকিছু সময় পর) ফিরে এলেন। তখনও তিনি বসেছিলেন। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আমি তোমাকে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম তুমি সেই অবস্থায়ই আছো ? তিনি বললেন হ্যাঁ। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনআমি তোমার কাছ থেকে যাওয়ার পর ৪টি কালেমা ৩বার পড়েছি। আজকে তুমি এ পর্যন্ত যা বলেছ তার সঙ্গে ওজন করলে এই কালেমা চারটির ওজনই বেশি হবে। কালেমাগুলো এইউচ্চারণ : সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, আদাদা খালকিহি, ওয়া রিদাআ নাফসিহি, ওয়া যিনাতা আরশিহি, ওয়া মিদাদা কালিমাতিহি।

অর্থ : আল্লাহ পবিত্র আর প্রশংসাও তার এ পবিত্রতা ও প্রশংসা তার সৃষ্ট বস্তুর সমান। তার নিজের সন্তুষ্ট সমান। (পবিত্রতা ও প্রশংসায় তিনি) তার আরশের ওজনের সমান। (পবিত্রতা ও প্রশংসায় তিনি) তার বাণীসমূহ লেখার কালির পরিমানের সমান। মুমিন মুসলমানের উচিত ফজর নামাজের পর হাদিসে উল্লেখিত কালেমা দ্বারা মহান আল্লাহর প্রশংসা করা। পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনায় সবার হওয়া। আর তাতেই মিলবে প্রকৃত সফলতা। হজরত উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন নবি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজ পড়ে সালাম ফিরিয়ে বলতেনউচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফেয়া ওয়া রিযকান তাইয়্যেবা ওয়া আমালান মুতাক্বাব্বালা। অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারি জ্ঞান চাই পবিত্র রিজিক চাই এবং কবুল হওয়ার যোগ্য আমল (করতে) চাই।

মনে রাখতে হবে : ফরজ নামাজের পর জিকির নিয়মিত করা উচিত, ছেড়ে দেওয়া উচিত নয় কারণ এটি সুন্নাহ এবং ফজিলতপূর্ণ। জিকির ও দোয়া মনোযোগ সহকারে করা, যাতে এর আধ্যাত্মিক প্রভাব পাওয়া যায়। জিকিরের সঠিক উচ্চারণ শেখা উচিত, প্রয়োজনে কোনো আলিমের কাছ থেকে শিখে নিন। আল্লাহতাআলা আমাদের সবাইকে নবীজির শেখানো জিকির প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর নিয়মিত পড়ার তাওফিক দান করুন। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবির (সা.)-শেখানো ফজরের নামাজের পর ৪ কালেমা সমৃদ্ধ তাসবিহটি বেশি বেশি পড়ার এবং আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ ব্যাচের এক অনন্য অনুষ্ঠান
পরবর্তী নিবন্ধকর্নেল জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম : নির্মোহ এক স্বপ্নযোদ্ধা