গাড়িচালকের সাথে ঘুমপরীর মিতালী

কামরুন নাহার পারভীন | বুধবার , ১৩ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের সকল ধরণের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সিএনজি। যে কোন প্রয়োজনে দ্বারস্থ হই সিএনজি টেক্সির। এই টেক্সিওয়ালা মামারা কেউ কেউ খুব মজাদার আর রসিক এরা টেক্সিতে উঠলেই গল্প জুড়ে দেয়। পারিবারিক কাহিনি নির্ভর অথবা দেশ/ রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা হলে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। এমনিতে আমি খুব অমনোযোগী শ্রোতা। ওদের গল্পে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। কেউ কেউ আছে আজাইরা প্যাঁচাল পারে। বিরক্তি চরম আকার ধারণ করলে ধমক দিয়ে চুপ করাই। অনেক মামা আছে তারা এত বেশি নম্র ভদ্র আপনাতেই শ্রদ্ধা চলে আসে।

এদের মধ্যে কিছু মামা আছে তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে টেক্সি চালায়। ২২ জুলাই, ২০২৫ হাসপাতালে ছোট নাতনীকে দেখে রাত ১১ টার পর আমরা বাসায় ফিরছিলাম। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল থেকে হালিশহর ওয়াপদা আসবো। টেক্সি মূল সড়কে উঠতেই আমার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিলো। টেক্সি চালানো কেমন জানি এলোমেলো। ব্যাপারী পাড়া আসতেই স্বভাবগতভাবে সামনের আয়নায় দেখলাম টেক্সিওয়ালার চোখ বন্ধ। যেহেতু নানা দুঃশ্চিন্তা আর ক্লান্তিতে বিধস্ত ছিলাম তাই মনকে প্রবোদ দিলাম, হয়ত চোখের পলক ফেলেছে। ছোটপুল পার হতেই মনে হলো টেক্সি আঁকাবাকা হয়ে চলছে। আবারো আয়নায় চোখ দিলাম। দেখলাম বেটা সত্যি ঘুমাচ্ছে। সাথে সাথে পিছন থেকে চিৎকার দিলাম। ব্যাটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে চোখকে জোর করে টেনে খোলা রেখে আমাদের গন্তেব্যে পৌঁছে দেয়। এতটুকু পথে আমি আয়না থেকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখ সরায়নি।

এরপর ২৬ জুলাই, ২০২৫ সকালে টেক্সি করে কর্মস্থল বন্দরটিলায় যাচ্ছি। অফিসে আসার পথটা চট্টগ্রামের বিখ্যাত ২টা জ্যাম স্পট (সল্টগোলা ক্রসিং ও ফ্রিপোর্ট মোড়) পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। জ্যাম এড়াতে আমি বিকল্প রাস্তা বন্দর সড়ক হয়ে নয়াহাট দিয়ে আসি। সকাল বেলা এই পথটা পার হতে ১৫/২০ মিনিট লাগে। টেক্সিওয়ালা একটু বয়স্ক। পোর্ট কলোনী ঢুকে কিছুদূর আগাতেই দেখলাম টেক্সিটা কেমন করে জানি চলছে। গতি খুব ধীর। অন্য টেক্সিগুলো সাঁই সাঁই করে আমাদের ফেলে ছুটছে। প্রথমে ভাবলাম বয়স্ক মানুষ হয়ত আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে। টেক্সিতে একা উঠলে আমি চোখ বন্ধ করে দোয়া কালাম পড়ি। পরিচিত পথের প্রতিটি বাঁক, মোড় নেওয়ার সময় বুঝতে পারি। কাষ্টম মোড়ে অস্বস্তি নিয়ে চোখ মেলে দেখি কেমন যেন ইতস্তত ভঙ্গিতে টেক্সিটা আগাচ্ছে। বয়স্ক মানুষ তার উপর সকাল বেলা মেজাজ তিরিক্ষি করতে চাইছি না তাই চুপ করে বসেছিলাম। সল্টগোলা মোড় হয়ে বন্দর সড়ক দিয়ে নয়াহাট অবধি সেইম স্টাইলে চলে আসার পর হঠাৎ আয়নায় দেখার কথা মনে হলো। ওমা দেখলাম বেটা আধো ঘুম, আধো জাগরণ অবস্থায় টেক্সি চালাচ্ছে। চিল্লানি দিয়ে বললাম, চাচা কী করছেন? আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। আমার চীৎকারে চাচামিয়া চোখগুলো মার্বেল সাইজ করে খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে শেষপথটুকু স্বাভাবিক গতিতে চালিয়ে আমাকে পৌঁছালো। ঘড়িতে দেখলাম ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চাচামিয়া ২০ মিনিটের পথ ৩২ মিনিটের মত লাগিয়েছে। অথচ রাস্তা পুরা ফাঁকা ছিল। গল্পগুলো হয়ত মজার ছলে শেয়ার করলাম। কিন্ত যখন তখন চালকের চোখে ঘুমপরীর আনাগোনা কী ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে তা ভাবলেই আঁৎকে উঠি। সড়কে প্রতিদিন তাজা প্রাণ ঝরছে। আমার মনে হয় প্রচণ্ড গতির চাইতে এই ঘুমপরীর আগমনের কারণে দুর্ঘটনা। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় আমার জানা নেই। তবে রাতে বা দুপুরে যে কোন গাড়িতে উঠলে ড্রাইভারকে একটু চোখ মুখ ধুয়ে গাড়ি চালাতে বলা যেতে পারে, নয়তো গাড়িতে বসে একটানা বকবক করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি হলে অবশ্যই চালককে বিরতী দিয়ে গাড়ি চালাতে দিতে হবে। পানি, চা তো থাকবেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনে প্রাণে কবিগুরু
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে