আগের দিনের শৈশব ও আজকের শৈশব

আবিদা সুলতানা লিজা | মঙ্গলবার , ১২ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

শৈশব, মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ এক অধ্যায়। এই সময়ে গড়ে ওঠে মানুষের ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ ও সম্পর্কের ভিত্তি। সময়ের প্রবাহে জীবনধারার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে শৈশবের রূপও। এক সময় শৈশব ছিল প্রকৃতিনির্ভর ও অবাধ স্বাধীনতায় ভরা, আর এখনকার শৈশব বেড়ে উঠছে যান্ত্রিকতা ও প্রযুক্তির ছায়ায়। ফলে গড়ে উঠছে এক ভিন্নধর্মী বাস্তবতা।

একসময় শিশুদের অবসর সময় কাটতো খোলা মাঠে নদী কিংবা পুকুরে। গোল্লাছুট, কাবাডি, কানামাছি কিংবা দাড়িয়াবান্ধা ছিল তাদের প্রিয় খেলা। খেলাধুলা, নদীতে সাঁতার, গাছে চড়া, কিংবা গাঁয়ের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো ছিল দৈনন্দিন অভ্যাস। মাঠের ধুলো, রোদবৃষ্টি আর প্রকৃতির ছোঁয়ায় তারা গড়ে উঠত প্রাণবন্ত ও জীবন্ত এক শৈশব নিয়ে। এখনকার শিশুদের শৈশব অনেকটাই ঘরবন্দি। নিরাপত্তাহীনতা, স্থান সংকুলান এবং ব্যস্ত নাগরিক জীবনের কারণে তারা বড় হচ্ছে মোবাইল, ভিডিও গেম, ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়াকে ঘিরে। খেলাধুলা এখন ভার্চুয়াল পর্দায় সীমাবদ্ধ।

শিক্ষাজীবনেও এসেছে পরিবর্তন। আগে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলার, গল্প শোনার ও নিজের মতো করে বেড়ে ওঠার সুযোগ ছিল। আজ শিশুরা ছোটবেলা থেকেই একাডেমিক চাপে পড়ছে। পড়ালেখা যেন এখন শেখার আনন্দের চেয়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার দৌড়। কোচিং, টিউশন, হোমওয়ার্কের চাপে তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে তাদের শৈশব।

পরিবার ব্যবস্থার পরিবর্তনও শৈশবকে প্রভাবিত করেছে। আগে শিশুরা বড় হতো যৌথ পরিবারে। দাদাদাদির স্নেহ, নানানানির গল্প, চাচাতো ভাইয়ের বোনেদের সাথে গল্প আড্ডা আর খেলাধুলা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল শৈশবের অনুষঙ্গ। এখন অধিকাংশ পরিবারই পরমাণু। বাবামা কর্মজীবী হলে শিশুর সময় কাটে একা, অথবা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সঙ্গে। এতে সামাজিক যোগাযোগ ও আবেগের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন শিশুকে দ্রুত তথ্য শেখার সুযোগ দিচ্ছে, অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী মনোযোগহীনতা, আসক্তি এবং একাকীত্বও সৃষ্টি করছে। আগের দিনের শিশুদের মধ্যে যে ধৈর্য, সহানুভূতি ও বাস্তবিক বন্ধন দেখা যেত, এখন তা অনেকাংশেই কমে গেছে। বাস্তব মানুষের চেয়ে ভার্চুয়াল চরিত্র তাদের কাছে বেশি আপন হয়ে উঠছে।

তবে একতরফাভাবে প্রযুক্তিকে দোষারোপ করাও ঠিক নয়। প্রযুক্তির সুচিন্তিত ব্যবহার শিশুর জন্য ইতিবাচক হতে পারে। দরকার শুধু ভারসাম্য। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, পারিবারিক সম্পর্ক, খেলার স্বাধীনতা এবং প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের সমন্বয়েই সম্ভব একটি পূর্ণাঙ্গ ও আনন্দময় শৈশব গড়ে তোলা।

আজকের প্রজন্ম যেন শুধুই পর্দার আলোয় বেড়ে না উঠে, বরং তারা যেন বড় হয় প্রকৃতির রোদবৃষ্টি, মাঠের ধুলো আর সম্পর্কের উষ্ণতায় এই কামনা আমাদের সবার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাস্তার টেকসই সংস্কার চাই
পরবর্তী নিবন্ধসবাই ভালো থাকবার অভিনয় করছে