ইমানুল

আবিদা মিলি | সোমবার , ১১ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

রিনা নাচো। আরো নাচো। এমন কইরা নাচো যেন, সকলের মনে মৌ ধইরা যায়। বাহ! খুব সুন্দর হইছে।

রিনা মাথা নেড়ে, কোমর হেলিয়ে নাচার ভঙ্গি করে।

ধরো, এই মালা তোমার গলায় শোভা পায়।

নিজের মাথায় বাঁধা লাল জবা ফুলের মালা খুলে ইমানুল রিনার গলায় পরিয়ে দেয়। দ’ুহাত ছড়িয়ে রিনাকে বুকে আহ্বান করেরিনা লাফিয়ে ইমানুয়েল বুকে আসে।

লেজ উঁচিয়ে ,মিয়াঁও মিয়াঁও শব্দে তার গায়ে গা ঘষতে থাকে।

ইমানুল : আমার সোনা মেয়ে, আইজ তোমারে এক থাল গরম ভাত খাওয়ামু। এতদিনের চেষ্টায় তুমি নাচটারে শিখতে পারছ।

জিন্সের পেছন পকেট থেকে ‘ক্লপিড এ এস’ এর খালি বাক্স বের করে টিপতে থাকে।

প্রথমে পাসওয়ার্ড খোলে, টো টু টো

,রিনা রিং পরতাছে। হ্যালো ‘খাদকস’ আপনাগো দোকানে কি গরম ভাত পাওয়া যাইবো?

কি কন, এত তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ হইয়া গেছে?

ইমানুল ১১ বছরের কিশোর বালক।

শ্যামবর্ণ। ঘোলা হলুদ দুটো চোখ আর ঠোঁটের দুপাশে ঘা। বাতাস লাগা মরু বালির ঢেউয়ের মতো না খেতে পাওয়া হাড্ডিগুলো ভেসে উঠেছে। তেলপানি না পাওয়া লম্বা লাল চুলের ভাঁজে ভাঁজে ময়লা। অনেক দিনের পুরনো ছেড়া প্যান্ট,তার চাইতেও আরো রং জ্বলা বেল্ট তার কোমর শক্ত করে আঁকড়ে রয়েছে। উপরে নেটের জালের মতো হাত কাটা সেন্ডো গেঞ্জি। দুর্বল ইমানুল দ’ুদিন কিছু খায়নি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। রাত এগারোটার কাছাকাছি। কোলে বিড়াল আর মিথ্যে মোবাইল নিয়ে খাবার খুঁজে বেড়ায় সে

রিনা খাওন পাওয়া যাইবো, চিন্তা কইরো না। আমি অন্য দোকানে ফোন করতাছি।

রাত দেড়টা পর্যন্ত সে বন্ধ দোকানের দরজা চাপড়ায়, একটু খাওন দেন না,আমি আর রিনা খুব ক্ষুধার্ত। একজন লোক সাইকেল চালিয়ে হয়তো নাইট ডিউটিতে যাচ্ছে। পেছনে হটপট রাখা।

ওই তো খাওন, তাড়াতাড়ি লও

ওই মানুষটা আমাগোরে খাওন দিব, গরম ভাত আর আন্ডা ভাজা।

ইমানুল সাইকেলের পেছনে হাঁটতে থাকেজোরে দৌড়ায়

সাইকেল আরোহী : এই পাগলা হাট এখান থেইকা, আবার পিছে আইলে এক থাবড়া খাবি।

ইমানুল হাল ছেড়ে দেয়

আমরা সকালে খাওন খামু, অখন লও ঘুমানোর জায়গায় ফিরা যাই।

ফ্রেন্ডস মেডিকো” ফার্মেসির সামনে টাইলস করা খালি জায়গায় রিনাকে বুকে নিয়ে ইমানুল শুয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানিতে ‘চুপসে’ জড়াজড়ি করে দুজনে ঘুমায়।

ধীরে ধীরে বৃষ্টির তোড় বেড়ে ওঠে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। রিনাকে কোলে করে ইমানুল বৃষ্টির পানিতে দাঁড়িয়ে থাকেআবর্জনার পানিতে তার পা দুটো কুঁচকে যায়ছপাৎ ছপাৎ পানি কেটে সামনের অধিক নোংরা পানিতে ইমানুল হেঁটে চলে।

.

জহির উদ্দিন সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানের কানে “আল্লাহু আকবর” শব্দে আযানের ধ্বনি শোনায়। স্ত্রীর চোখ পিটপিট করে জ্ঞানে ফিরবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। চোখ খুলো, দেখো, আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে কি সুন্দর পুত্র সন্তান দান করেছেন।স্ত্রীর কপালের ঘাম হাত দিয়ে মুছিয়ে দেন। স্ত্রী চোখ মেলে তাকায়, পুত্রকে দেখে, স্বামীস্ত্রী দুজনে মুচকি হাসে

জহির ‘আগুন ধরা রূপবতী’ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেনশার্টের কলার টেনে স্বামীকে নিকটে নিয়ে আসেন স্ত্রীআমার কথা কিন্তু শুনতেই হবে, ফেলতেপারবেনা

জহির উদ্দিন : পেরেছি কখনো, অবশেষে জয়ী তুমিই হওতবে ডান’

জহির স্ত্রীর নাকে হালকা ঘুষি দেয়,ডান

আমাদের পুত্রের নাম হবে “ইমানুয়েল কান্ট”।

জহির বিছানায় মাঝখানে ছোট বালিশ, কোলবালিশ,মশারি সাজিয়ে রাখে। আজ ওরা আসবে

জহির বিএ পাস। বিল্ডিংএর কেয়ারটেকার হবার সুবাদে ছোট্ট একটা রুম আর আধাখানা ব্যলকনি থাকবার জায়গা হিসেবে পেয়েছে। অপরূপা সুন্দরী আর মেধাবী মিথিলাকে দুবছর আগে বিয়ে করে সে। মিথিলা ‘দর্শন’ সাবজেক্টে অনার্স পড়া অবস্থায় তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের রাতে মিথিলা পড়া চালিয়ে যাবার অনুরোধ করেছিল তার কাছে। অভাবে অনেক অনুরোধ শেষ পর্যন্ত রাখতে পারে না জহির। বাবু পেটে আসার পর থেকেই মিথিলার আবদার ছিল আমি কিন্তু সন্তানের নাম দার্শনিকের নাম অনুসারে “ইমানুয়েল কান্ট” রাখবো। জহির রাজি হয়নি। কেন নাম খুঁজে পাচ্ছ না? নামের বই এনে দেবো? জহির একা ঘরে মনে মনে হাসেশব্দ করে পুত্রের নাম উচ্চারণ করেআমার ইমানুল, ইমানুয়েল কান্ট ।

.

বড় কালো কড়াইতে পুরি ভাজা হচ্ছে। বসে থেকে ইমানুল ডুবু তেলে পুরিগুলোর নাচন দেখে, একটা পুরি পাবার বাসনায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে রয়।

দোকানদার : এই পাগলা সর।

ইমানুল একটু পিছিয়ে আবার বসে পড়েদোকানী তার গায়ে পানি ঢেলে দেয়।

সে উঠে হাঁটতে থাকে, সামনে এগোয়

এই পাগলা খাবি?

মাথা নেড়ে হু জানায়

বাতেন মিঞার ভাতের হোটেলে ইমানুল আসন পেতে বসে রয়

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় বড়বোলে মাছের মুড়ো ঘন্ট খেতে দেয়। মুগ ডাল দিয়ে রুই মাছের মাথার বাসি তরকারি, ইমানুল আর রিনা খেয়ে চলে

একটু ভাত দেনফেনা ওঠে টক হওয়া বাসি ডালের অনেকটাই খেয়ে, ভাতের আশায় বসে রয়। একটু ভাত দিবেন?

হোটেল বয় : ভাত নাই, তাড়াতাড়ি সর, দোকান বন্ধ করুম।

.

সদ্য জন্ম নেওয়া ইমানুল ধীরে ধীরে বড় হয়ে আজ পাঁচ বছরের বালক।

মিথিলা: টিভি বন্ধ করো।

ইমানুল : মা আমার মিনা কার্টুন পছন্দ। আরেকটু দেখি।

মিথিলা: না বাবা, ভাত খেয়ে ব্রাশ কর, তারপর অযু করে ঠিক দশটায় ঘুমিয়ে পড়ো।

ইমানুল: কেনো মা, একটুখানি দেরি কইরা ঘুমাইলে কি হয় ?

মিথিলা: দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট প্রতিদিন একই সময়ে হাঁটতে বের হতেন,যার কারণে স্থানীয়রা তার সময় দেখে ঘড়ি মেলাতো। তুমিও ওনার মত নিয়ম করে চলার চেষ্টা করবে। দার্শনিককে নিয়ে মাছেলের বেশ কিছুক্ষণ কথা চলেআমার সোনা বাবা ,এসো ‘মা’ ভাত খাইয়ে দিই,

ইমানুল: আইজ কি তরকারি রানছো?

মা: গরম ভাত আর ডিম ভাজি।

ইমানুল: গরম ভাত আর আন্ডা ভাজা ,খুব ভাল খাবার।

খাড়াও আমি অখনি খাইতে আইতাছি।

আইজ খুব মজা হইব।

.

বাচ্চাদের ধাওয়া খেয়ে ইমানুল পাগলা দুই বিল্ডিং এর চিপায় লুকায়। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝখানে ঘুটঘুটে অন্ধকারেও উল্টে যাওয়া পায়ের নখে গল গলিয়ে রক্ত অনুভব করে।

শিশুরা: পাথর ছুঁড়ে মারে, পাগলা রাস্তায় আর পায়খানা করবি?

দ্বিতীয় শিশু: রাস্তা নোংরা করলি কেন?

শিশুরা সমস্বরে : পাগলা তোর বিলাই কই ? পাগলা তোর বিলাই কই?

উল্টে যাওয়া নখে, বাতের কালো চুড়ি পরা পা নিয়ে ইমানুল টয়লেট করবার স্থান খুঁজে বেড়ায়

বর্ষায় থোকা থোকা ফুল ছড়িয়ে কদম গাছ প্রকৃতির শোভা আরো বাড়িয়ে তোলে। অথচ প্রকৃতিরই আরেক সেরা সৃষ্টিমানুষ, সেই কদম গাছের তলায় অবহেলায় ও বঞ্চনার ভার নিয়ে নীরবে পড়ে থাকে।

ইমানুল: রিনা, সেইদিন মুগ ডাইল খাওনের পর থেইকা আমার পেট খারাপ হইছে। শব্দ কইরো না। এই গাছ তলায় চুপচাপ বইসা থাকো।

দূরে জাহান মঞ্জিল, দারোয়ান গেইট খুলে দোকানে যায়

খোলা দরজায়,রিনাকে কোলে নিয়ে ইমানুল মঞ্জিলে ঢুকে পড়ে।

দারোয়ানের বাঁশির ফুঁ শব্দে চতুর্দিকে লাইট ফটাফট জ্বলে ওঠে। সাদা ঝকঝকে টাইলসের উপর ইমানুলের টাটকা কাঁচা পায়খানার গন্ধ জাহান মঞ্জিলে ছড়িয়ে পড়ে।

সভ্য মানুষেরা এই ধর ধর, সর সর ,মার শব্দ নিয়ে এলোমেলো ছুটতে থাকে।

দারোয়ান দুচার ঘা বসিয়ে গেইটের বাইরে তাড়িয়ে দেয় তাকে।

ইমানুল: আমার রিনারে দেন,রিনা ভিতরে রইছে।

রিনা আহো,আমার কাছে আহো।

.

মোবাইলে রিং বেঁচে চলছেজহির ফোন রিসিভ করে, জি ভাইজান, আসসালামু আলাইকুম।

ভাইজান: তুমি আমার কথা শোনো, এইভাবে একলা চলা যায় না। ইমানুলতো কষ্ট পাচ্ছেই তার চেয়ে বেশি কষ্ট তোমার।

বাচ্চা নিয়ে শহর বাড়িতে কিভাবে একা দিন কাটাবে?

পাত্রীর মাবাবাকে সবকিছু বলেছি। সমস্যা হয়তো কিছুদিন হবে পরে সব কিছু এডজাস্ট হয়ে যাবে।

কি বলো, বাড়ি আসছো তো?

জহিরের কথাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়

আজ ২১ দিন মিথিলা মারা গিয়েছে। সেদিন রাতে ইমানুল ঘুমানোর পর, পাশাপাশি শুয়েছিল দুজনে

মিথিলা: জানো দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মূল তথ্যগুলোর মধ্যে একটা ছিল, “যা তুমি করবে, তা যেন এমন হয় যে, তা সার্বজনীন আইন হতে পারে।”

জহির: ক্যান্ট স্যার, আপনি আমার সহায় হোন, এই মুহূর্তে আমার স্ত্রীর মাথা থেকে প্রস্থান নিন। আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। মিথিলার আজ বুকে ব্যথা, দয়া করুন আমায়।

মিথিলা: জহিরের বুকে পিঠে কিল ছুঁড়তে থাকে।

রাত তিনটার দিকে মিথিলার বুকে ব্যথা বেড়ে যায়। ফজরের আযানের কিছু আগে আল্লাহর মেহমান হয়ে এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেয় সে।

.

দেওয়ালে দুটো টিকটিকি জোড়া লেগে খেলছে। টিকটিকির ভয়ে ইমানুল মুখে বালিশ চেপে বাবার অপেক্ষায় রয়। বাবা ইমানুলের জন্য নতুন ‘মা’ আনবে বলে, বাড়ি গিয়েছে। তাই ফিরতে দেরি হবে। পাতিলে ঠান্ডা ভাত, আলু ভর্তা। বাবার অপেক্ষায় থেকে, না খেয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।

জহির দ্বিতীয় বিয়ে করেছে দুই মাস।

দ্বিতীয় স্ত্রী: তুমি বিবাহিত, সন্তানের বাবা, এতকিছু মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

জহির: দেখো, তোমার বাবা মাকে ভাইজান সবকিছু জানিয়েছিল।

স্ত্রী: আমাকে জানানো উচিত ছিল তোমার।

জহির: বিয়ের আগে তোমার সাথে কখনো কথা হয়নি আমার। তা তো তুমি জানো।

স্ত্রী: এত কিছু বুঝি না আমি। তোমার উপর চাপিয়েও দিচ্ছি না। তুমিই সিদ্ধান্ত নও

এই ঘরে হয় তোমরা দুজন থাকো, নয়তো আমরা দুজন।

.

চাষাড়ার লোকাল ট্রেন থেকে নেমে, চট্টগ্রাম যাবার উদ্দেশ্যে কমলাপুর স্টেশনে দুটো টিকিট কাটে জহির। চট্টগ্রামের নেভী হাসপাতাল গেইট। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। বিশাল বড়বাজার। হরেক রকম দোকানের পসরা সাজানোবাজারের “ফ্রেন্ডস মেডিকো” ফার্মেসির দোকানে ইমানুল বন রুটি আর কলা খাচ্ছে।

জহির: ভাই আমার বাচ্চাটাকে একটু দেখেন, আমি এক বোতল পানি নিয়ে আসছি।

দোকানী: ঠিক আছে। জহির উদ্দিনকে আর কোনোদিন দোকানের আশেপাশে দেখা যায় না।

সেই থেকে ইমানুল বাজারের পচা পটল, ভাঙা টব, ফেটে যাওয়া প্লাস্টিকের মতন গন্ধ মানুষ হয়ে ছিটকে বেড়ায়।

.

দুদিন পর্যন্ত কদম গাছের ছায়ায়মায়ায় ইমানুল জাহান মঞ্জিলের নিকটে দাঁড়িয়ে রয়। দ্বিতীয় তলায় রিনাকে দেখতে পাওয়া যায়। ওই তো আমার রিনা, রিনা ফিরা আসো, আমার কাছে আসো। একলা খুব ভয় লাগে, অক্ষণী নাইমমা আসো। গভীর রাতে ইমানুল ওয়াল টপকে মঞ্জিলের ভিতরে প্রবেশ করেলোকেদের হুল্লোড় শুরু হয়, মোবাইল চোর, হিরনঞ্চি, কিশোর গ্যাং, ধরোধরো

সারারাত বেধড়ক মার খেয়ে, সকাল পর্যন্ত আধমরা ইমানুল বেঁচে থাকে, পেছনে ফেলে যাওয়া বাবার ফিরে না আসার মুহূর্ত ভেবে।

উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ইমানুলের এক চোখ খুলে পড়েছে। রক্তমাখা আরেক চোখে ইমানুল সাদা শাড়ি পরিহিতা মা’কে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। দুই হাত, দুই পায়ে গড়া একজন মানুষ ছাতার ডাঁট দিয়ে ইমানুলের পিছনে গুঁতো মেরে প্রশ্ন করে “ওই পাগলা, তোর নাম কি রে?” প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার সময়, শরীরের সকল শক্তি দিয়ে সে চিৎকার করে বলে,

আমি ইমানুয়েল কান্ট”। দর্শক সারিতে অনেকেই হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগুজরাট
পরবর্তী নিবন্ধডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া আক্রান্তদের জন্য পর্যাপ্ত কিট ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের দাবি