হল্যান্ড থেকে

নিক্সনের ‘পিং পং ডিপ্লোমেসি’ থেকে ট্রাম্পের ‘গলফ-ডিপ্লোমেসি’

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৯ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ‘পিংপং ডিপ্লোমেসির’ কথা আপনাদের মনে আছে? ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ৯ সদস্যের একটি মার্কিন টেবিল টেনিস টিম প্রথমবারের মত চীন সফরে গিয়েছিল। সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক সফর। কারণ ১৯৪৯ সালে চীন বিপ্লবের পর আমেরিকা ও চীনএই দুই দেশের মধ্যে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিলনা। ব্যবসাবাণিজ্য যা হতো তা ছিল খুব সীমিত। বলা চলে কয়েক দশক ধরে এই দুই দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে কোন যোগাযোগ ছিল না। দুদেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেছিল। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে এই ঐতিহাসিক টেবিল টেনিস টিমের চীন ভ্রমণকে দুদেশের মধ্যে বিরাজমান শীতলসম্পর্ক উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আর সেই কারণে এটি ‘পিং পং কূটনীতি’ বা ‘পিং পং ডিপ্লোমেসি’ হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এর ফলে দুদেশের জনগণের মধ্যে বোঝাপড়া এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটে। পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭২ সালে বেইজিং সফর করেন। এই সফর সাংহাই ইশতেহারের পথ যে প্রশস্ত করেছিল তা বলাই বাহুল্য। সাংহাই ইশতেহার ছিল নিক্সনের চীন সফরের সময় জারি করা একটি ঐতিহাসিক কূটনৈতিক দলিল। দুই দেশ পারস্পরিকসম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে শান্তির বীজ রোপণ করেছিল।

আমেরিকা কেন চীনের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করতো তার পেছনের কারণটুকু খুঁজে দেখলে আমরা দেখতে পাই, ১৯৫০ সালে চীন কোরীয়যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে একটি আগ্রাসী জাতি হিসাবে চিহ্নিত করে এবং চীনের উপর নিষেধাজ্ঞা সহ একটি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রয়োগ করে। দুই দেশের মধ্যে প্রায় দুই দশক কোন ধরনের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পর উভয় দেশ অবশেষে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পায় এই খেলার (১৯৭১ ওয়ার্ল্ড টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ) মধ্যে দিয়ে। চীন সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তাদের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে একটি কার্যকরী ও উপকারী প্রতিহতকারী হিসাবে দেখে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও উত্তর ভিয়েতনামের সাথে শান্তি আলোচনায় চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সুবিধা হিসাবে দেখেছিল। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সংস্কৃতিবিনিময়, খেলাধুলা বৈরী ভাবাপন্ন জনগণ ও দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখে। সে প্রমাণ আমরা পাই চীনআমেরিকার সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। চীন টেবিল টেনিস দলের কোচ বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই সব সময় আমাদের মনে করিয়ে দিতেন যে, আমরা কেবল প্রতিযোগিতা করার জন্যে খেলতে আসিনি, বরং বন্ধুত্ব তৈরি করতে এসেছি এবং মানবতার বার্তাকে এগিয়ে নিতে এসেছি।’

) আজ থেকে অর্ধশত বছরের বেশি আগের বিশ্ব রাজনীতির এই প্রেক্ষাপট মনে এলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গেল সপ্তাহে যুক্তরাজ্য সফরের সময় স্কটল্যান্ডে তার নিজস্ব গলফ কোর্সে (মাঠ) গলফ খেলতে দেখে। কেউ কেউ ট্রাম্পের স্কটল্যান্ডসফরকে তার ‘গলফ ডিপ্লোমেসি’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন, যদিও বা দুটোর প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা তার সমালোচকদের মতে, ট্রাম্প স্কটল্যান্ড এসেছেন তার ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা ছিল স্কটল্যান্ডে তার মালিকানাধীন দুটি গলফ খেলার মাঠে যাওয়া। এর একটি হলো আবেরডিনশায়ারে ‘ট্রাম্প ইন্টারনাটিওয়াল স্কটল্যান্ড’ এবং অন্যটি ‘ট্রাম্প টার্নবেরি’। ট্রাম্প ঝানু ব্যবসায়ী ও নিজের স্বার্থটাই বেশি দেখেন তাতে কারো কোন সন্দেহ নেই। তিনি যে দরকষাকষিতে চ্যাম্পিয়ন তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। নিজের ব্যবসার প্রসারে তিনি তার পদের ও হোয়াইট হাউজকে ব্যবহার করছেন বলে অনেকের অভিযোগ। তাই ট্রাম্প যখন স্কটল্যান্ড গেলেন তখন তার সমালোচকরা বলেন, বাণিজ্যিক আলোচনাটালোচনা আসলে কিছুই না। তার মূল উদ্দেশ্য সে দেশে তার নূতন গলফ কোর্সের উদ্বোধন করা এবং বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা। অবশ্য হোয়াইট হাউজ ট্রাম্পের এই সফরকে ‘ওয়ার্কিং ভিজিট’ হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং বলে, ‘ডোনাল্ড ট্রাপ স্কটল্যান্ডে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রধান উরসুলা ফন দের লিয়েনের সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং ব্রিটেন ও ইউরোপের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলাপআলোচনা করবেন।’

তবে মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই স্কটল্যান্ডে ট্রাম্পের গলফমাঠ সফরের বিরোধিতা করলেও তার সমর্থকেরও অভাব নেই। ৪৩ বছরের স্কটিশ নাগরিক মার্টিন লিয়ন ‘স্কটিশ সান’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ট্রাম্প আমাদের জন্য স্কটিশ সরকারের চাইতে অনেক বেশি করেছেন। তার গলফ কোর্স অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’ আর এক স্কটিশ নাগরিক বলেন, ‘তার উচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার ও স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার সুইনিকে বলা, যাতে তারা তার (ট্রাম্প) মত প্রথমে তাদের নিজস্ব লোকদের স্বার্থের দিকে নজর দেন।’ স্থানীয় এক ইঞ্জিনিয়ার নাম জন ইনগ্রাম, বয়স ৫০ এই বলে মন্তব্য করেন, ‘ট্রাম্প একজন প্রতিভাবান রাষ্ট্রপ্রধান এবং তিনি কোনো ঝামেলা করেন না।’ নিজ সরকারের সমালোচনা করে এই ব্যক্তি বলেন, ‘ট্রাম্প এই গলফ কোর্স করে পরোক্ষভাবে এই এলাকার জন্য অন্য কারো চাইতে অনেক বেশি কিছু করেছেন। ট্রাম্প স্টারমার ও সুইনিকে পদত্যাগ করতে বললে আমি খুশি হবো।’ তবে খুশি নন ৬৮ বছরের হিদার চিভাস। তার মতে, ‘ট্রাম্প এখানে এলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। জানি না তার পুরো সফরের জন্যে এত অর্থ কোথা থেকে যোগান দেয়া হয়।’ যুক্তরাজ্যের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা লেখে, ট্রাম্পের গাড়ি বহর তার গলফ কোর্সে পৌঁছানোর সাথে সাথে কিছু লোক প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ করেন। এই ক্যাম্পেইন গ্রুপ তাদের এই প্রতিবাদকে ‘ফেস্টিভ্যাল অফ রেজিস্টেন্স’ বা ‘প্রতিরোধের উৎসব’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। মায়ের সূত্রে ট্রাম্পের রয়েছে স্কটল্যান্ডের সাথে বিশেষ সম্পর্ক ও ভালো লাগা। সে কথা তিনি নানা সময়ে জনসমক্ষে বলেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তা সত্ত্বেও ৭০% স্কটিশ নাগরিক ট্রাম্পকে পছন্দ করেন না। এই তথ্য জানা গেছে মার্চ মাসে আই পি এস ও এস নামক এক মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি পরিচালিত জরিপ থেকে। স্কটল্যান্ড সফরের আগে আমেরিকার লিবারেল নিউজ ওয়েবসাইট এবং পলিটিক্যাল ব্লগ ‘হাফিংটন পোস্ট’ বা সংক্ষেপে ‘হাফপোস্ট’ লিখেছিল, ‘মার্কিন করদাতারা আগামী কয়েকদিনে কমপক্ষে ১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করবেন যাতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্কটল্যান্ডের আবেরডিনশায়ারে তার গলফ রিসোর্টে মার্কেটিং ফটো শুটিংয়ে অংশ নিতে পারেন। এর ফলে যে লাভ হবে তা যাবে তার নিজের পকেটে। ওয়াশিংটনস্থ ‘সিটিজেনস ফর রেসপনসিবিলিটি এন্ড এথিক্স গ্রুপ এর কর্মকর্তা জর্ডান লিবোবিৎজ বলেন, ‘আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে ওভাল অফিস ট্রাম্পসংস্থার একটি এক্সটেনশন মাত্র। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন একজন প্রেসিডেন্টের বিদেশে অর্থ উপার্জনে সময় ব্যয় করা উচিত নয়।’

তবে সমালোচনায় ট্রাম্পের কিছু আসে যায় না। তার যা করার তিনি তা করেই ছাড়েন। তার সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক নথি থেকে জানা যায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে ক্রিপ্টো কারেন্সি উদ্যোগ, বিদেশী বিনিয়োগ, বেসরকারি ক্লাব এবং ট্রাম্পব্রান্ডযুক্ত পণ্য বিক্রি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। ট্রাম্প ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে কিছুটা রয়েসয়ে দেশিবিদেশি সরকার থেকে উপহার সামগ্রী গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তিনি অনেকটা বেপরোয়া হয়ে গেছেন বলে তার নিন্দুকেরা দাবি করেন। তারা বলেন, ট্রাম্প সমালোচনাকে খুব একটা ‘আমলে’ নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কাতার সরকার থেকে উপহার হিসাবে গ্রহণ করা ৭৪৭ লাক্সা৭রি জেট বিমান যা কিনা এয়ার ফোর্স ওয়ান হিসাবে ব্যবহৃত হবে বলে প্রকাশ। ট্রাম্পের নিন্দুকেরা মনে করেন, এটি মার্কিন সংবিধানে উপহার সামগ্রী সংশ্লিষ্ট ধারার বিরুদ্ধে এবং এর মধ্যে দিয়ে কাতার ট্রাম্পের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা লাভ করতে চাইবে। এই সমস্ত অভিযোগকে একপাশে রেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি এটি কাতারের একটি প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি।’ ট্রাম্প তার ব্যবসার কারণে তার পদকে ব্যবহার করার যে অভিযোগ তা তিনি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও সিএনএনের মতে, ট্রাম্পের পরিবারের ব্যবসা প্রথম মেয়াদের চাইতে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনগুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবতার ওপর জুলুম : সার্বত্রিক ধ্বংসের মূল কারণ
পরবর্তী নিবন্ধরাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন জরুরি