ভবিষ্যতের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে জনগণ

অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তিতে অভিনন্দন

| শুক্রবার , ৮ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে আমাদের প্রাপ্তিঅপ্রাপ্তি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে দেশে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর অবিরাম শ্রম দিয়ে আসছেন তিনি একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ জনগণকে উপহার দিতে। তিনি বলেছেন, টানা ১৬ বছরের ‘স্বৈরাচারী অপশাসনের’ বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থান। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংস্কার কার্যক্রম নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি বলেন, ‘একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধানের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলোএকটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।’

কেউ কেউ বর্তমানকে ‘অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো’ দেখছেন। নিরাপত্তা, জিনিসপত্রের দামের কথা তাঁরা বলছেন ‘স্বাভাবিক’। তাঁরা বলেন, ‘অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। জিনিসপত্রের দাম কমছে, আগে অনেক বেশি দাম ছিল।’

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে কয়েকজন শিক্ষার্থীর আহ্বানে ‘কোটা সংস্কারের’ দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। প্রথমে ছিল ছোট পরিসরের বিক্ষোভ, পরে তা ‘আগুন’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজসহ সবার কণ্ঠেই উঠে আসে একই সুর– ‘বৈষম্যের অবসান চাই’।

তৎকালীন সরকার এই আন্দোলন দমন করতে কঠোর অবস্থান নেয়। টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, নির্যাতন, গুমসবই প্রয়োগ করে। কিন্তু দমনের সেই নীতি বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। আন্দোলন পায় জনসমর্থন, ধীরে ধীরে রূপ নেয় গণআন্দোলনে। পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। ৫ আগস্ট পরিণত হয় ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর এক জীবন্ত ইতিহাস। অনেকেই এটিকে বলেন-‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্মক্ষণ’।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এ ঘটনাকে অনেকে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ফাইনাল আউটপুট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, ২০২৪ সালের জুলাইআগস্টের আন্দোলন নিছক রাজনৈতিক চাপ তৈরি করার প্রচেষ্টা ছিল না। বরং এটি ছিল একটি যুগান্তকারী গণঅভ্যুত্থান, যেখানে দেশের নাগরিক সমাজ ও তরুণ নেতৃত্ব একসঙ্গে নিজেদের চূড়ান্ত অবস্থান স্পষ্ট করেছিল। তাঁরা বলেন, ‘৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী এক বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলোএই দেশ থেকে শেখ হাসিনার মতো একজন স্বৈরাচার, ভারতঅনুগত শাসনের অবসান ঘটানো। আমরা বহু বছর ধরে একটি দমনপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার মধ্যে থেকেছি, যেখানে একটা পোস্টার টানানো, একটা প্রতিবাদ সমাবেশ করা মানেই ছিল রিমান্ড, গুম কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যার ভয়। সেই বাস্তবতা থেকে আজ অন্তত আমরা মুক্তভাবে নিশ্বাস নিতে পারছি।’ তাঁদের মতে, গত এক বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে ‘গণমানুষের ঐক্য’। মানুষ ঐক্যবদ্ধ ছিল। আন্দোলনের সময় এত বড় উত্তেজনা, সহিংস পরিস্থিতির পরও দেশে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এটিই আমাদের বড় বিজয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে বিগত বছরগুলোতে যে মাত্রায় দমনপীড়ন চলেছে, সেই তুলনায় গত এক বছরে তুলনামূলক সহনশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুরোপুরি তৈরি না হলেও কিছুটা তৈরি হয়েছেএটাই আমাদের লড়াইয়ের ইতিবাচক দিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোবিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষ এখন টেবিলে বসে আলোচনা করছেন, মতবিনিময় করছেন। বাংলাদেশে এমন দৃশ্য এর আগে ছিল বিরল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সবচেয়ে বড় আশার কথা হলো এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের কতগুলো আকাঙ্ক্ষা অনেক মূর্ত ও স্পষ্ট হয়েছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও রীতিনীতি বিষয়েও সচেতনতা বেড়েছে। ফলে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাতারাতি রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলেও আশা করা যায়, ভবিষ্যতে কোনো শাসক দলের পক্ষেই আগের মতো একচেটিয়া দুঃশাসন চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না।’

তাঁদের মতে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনে এই আন্দোলন একটা মোড় ঘোরানো অধ্যায় হয়ে বিবেচিত হবে। আমাদের পথচলা থেমে নেই। সামনে আরও দীর্ঘ পথ। আশা করছি, আগামী দিনে এই পরিবর্তন আরও দৃশ্যমান হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস আগামী রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের প্রাপ্তি শুধু হাসিনা পতনে আটকে না থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাক, গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে আপাতত এটাই চাওয়া। জনগণ তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের দিকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে