কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক তাঁর এক লেখায় লিখেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, একটা দেশের সাহিত্য যত উন্নতই হোক না কেন, যদি সেখানে শিশুসাহিত্যিক না থাকেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত তা অপূর্ণই থেকে যায়। পৃথিবীর যেখানেই বড় সাহিত্যিক রয়েছেন তারা প্রত্যেকেই শিশুদের জন্য অসাধারণ সব গ্রন্থ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু এ জায়গাটিতে ফাঁকি দেননি, তিনি শিশু–কিশোরদের জন্য লিখেছেন। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্রও লিখেছেন। এই যে বড় লেখকেরা লিখলেন, এটা আমাদের এখানে তেমন দেখতে পাই না। এটা আমার কাছে নিদারুণ একটা অভাব বলে মনে হয়।’
তাঁর কথাটি মেনে নিয়েও বলতে চাই আমাদের দেশেরও বেশ কয়েকজন বড় লেখক ছোটোদের জন্য লিখে আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে হাসান আজিজুল হকও একজন। তাঁর ‘লাল ঘোড়া আমি’ অসাধারণ একটি গ্রন্থ। সেই তালিকায় পাই শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, রাহাত খান, হুমায়ুন আজাদ, সুব্রত বড়ুয়া, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, আমজাদ হোসেন, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকারসহ আরো অনেককে। তাঁরা প্রত্যেকে উপহার দিয়েছেন অনন্যসাধারণ গ্রন্থ। তাঁদের কাহিনি নির্মাণ, ভাষার ব্যবহার ও উপস্থাপনায় মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়।
লেখক ও উন্নয়নকর্মী নিশাত সুলতানার ভাষায়, ‘সাহিত্যের যেকোনো ধারার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হলো শিশুসাহিত্য। শিশুসাহিত্য রচনা করতে হয় অনেক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। আমাদের সাহিত্যের চরিত্ররা মূলত আমাদের প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের আদলেই তৈরি। ব্যতিক্রম নয় শিশুসাহিত্যও। শিশুসাহিত্যের বিষয়বস্তু ও চরিত্রায়নে সনাতনী মানসিকতা কিংবা সীমাবদ্ধতা শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই কাহিনি, ভাষার ব্যবহার, অলংকরণ, রঙের ব্যবহারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।’
বহু ঘাত–প্রতিঘাত পেরিয়ে আমাদের শিশুসাহিত্য এখন সর্বপ্রান্তস্পর্শী মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সাহিত্যের অপরাপর শাখার মতো শিশুসাহিত্যও এগিয়ে গেছে সমান্তরালে, হয়েছে সুদূর প্রসারী ও দিগন্ত বিস্তারী। সম্ভাবনার বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের অগ্রযাত্রা রীতিমত গর্বের বিষয়। আমীরুল ইসলাম তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদের শিশুসাহিত্য কখনো জঙ্গিবাদ বা মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। পাকিস্তান আমল জুড়ে ছিল মৌলবাদী চেতনার ও ধর্মীয় রাজনীতির সুবিধাবাদী বিকাশ। কিন্তু আমরা সেখানে বৃত্তাবদ্ধ থাকিনি। কিছুদিনের মধ্যে আমরা ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার সংগ্রামে আত্মত্যাগী হয়ে উঠলাম। এলো স্বাধীনতাসংগ্রাম। …আমরা মুক্তিকামী লেখকরা শিশুসাহিত্যের পথে এগিয়ে চললাম। গণমানুষের শিশুসাহিত্য, মানুষের অধিকার যেখানে বড় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বতন্ত্র ধারার শিশুসাহিত্য যাঁরা নির্মাণ করেছেন, তাঁদের তালিকা অনেক বড়। অনেকে জীবন উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায়।’ সেহিসেবে বলা যায়, আমাদের শিশুসাহিত্যিকরা সবসময় সময়ের দাবি মিটিয়ে এসেছেন নানা সময়ে। আন্দোলনে–সংকটে পালন করেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। লুৎফর রহমান রিটন বলেন, ‘শিশুসাহিত্যিকদের ফুলপাখি নদী নিয়েই লিখলে শুধু হবে না, লিখতে হবে সমাজের অবকাঠামোগত বিষয়, অন্যায় অবিচার নিয়ে, মানবিকতার পক্ষে, সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসামপ্রদায়িকতার পক্ষে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে। আমি আমার সারাজীবন সেই কাজটাই একাগ্রচিত্তে করেছি’।
২.
আমরা জানি, আমাদের জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত জীবনমুখী আধুনিক শিশুসাহিত্যের বিকাশের পর্বটি সূচিত হয়েছিল স্বাধীনতা–পূর্ব সময় থেকেই। ছোটোদের রুচি গঠন ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরিতে সহায়ক ‘বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য’ এখন বিচিত্র ও বহুমাত্রিক। নিজস্ব মৃত্তিকার ইতিহাস–ঐতিহ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চেতনার মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের নবযাত্রা সূচিত হয়েছে। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে প্রায় সর্বপ্রান্তস্পর্শী। আমাদের শিশুসাহিত্যের অঙ্গনও উদ্ভাসিত হয়েছে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সাহিত্যকৃতির বর্ণিল পুষ্প–পল্লবে।
বলতে গেলে ‘বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য’ বিষয়ে গবেষণা খুব কমই হয়েছে। এই বিষয়ে বাংলা ভাষায় আমাদের দেশে স্বাধীনতা–উত্তরকালে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে রয়েছে, উৎসে ফেরার ছলচাতুরী – হায়াৎ মামুদ (প্রকাশক : দি মিডিয়া, ঢাকা), ১৯৯৬, শিশুসাহিত্য : নানা প্রসঙ্গ– আতোয়ার রহমান (প্রকাশক : বাংলা একাডেমি, ঢাকা), ১৯৯৮, শিশুসাহিত্যের কতিপয় রথী– আতোয়ার রহমান (প্রকাশক : বাংলা একাডেমি, ঢাকা), ২০০১, শিশুসাহিত্যের রূপরেখা – আহমাদ মাযহার (প্রকাশক : শোভা প্রকাশ, ঢাকা), ২০০৯, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য : মনন ও মনীষা – আহমাদ মাযহার (প্রকাশক : কথাপ্রকাশ, ঢাকা), আমাদের শিশুসাহিত্য : নানারঙের ঢেউ – সুজন বড়ুয়া ( প্রকাশক : অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা), ২০১৭, শিশুসাহিত্যের আলো ছায়া –আমীরুল ইসলাম (প্রকাশক–সপ্তডিঙা, ঢাকা) প্রভৃতি। এছাড়াও আছে আরো কয়েকটি গ্রন্থ। উপরে উল্লিখিত বইগুলোতে দেশের শিশুসাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের ওপর আলোচনা স্থান পেলেও শিশুসাহিত্যগবেষণা নিয়ে খুব একটা হয় নি।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে ‘গবেষণা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যদিও আমরা জানি, এ ধরনের কোনো গবেষণাই পূর্ণাঙ্গ হয় না। একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে ধীরে ধীরে পরবর্তীকালে গবেষকরা একে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। তবু নিচের কয়েকটি প্রবন্ধের কথা আমি স্মরণ করছি। যেমন– ক. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ : বাংলাদেশের ছড়া, সুন্দরম, জ্যৈষ্ঠ–শ্রাবণ ১৪০৪। খ. বিশ্বজিৎ ঘোষ : বাংলাদেশের ছড়ায় গণচেতনা, কালি ও কলম, মার্চ ২০১৩। খ. আবু হাসান শাহরিয়ার : বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের অগ্রযাত্রা, শৈলী, ১অক্টোবর ১৯৯৭। গ. খালেদ হোসাইন: বাংলাদেশ সামপ্রতিক ছড়া: পর্যালোচনা, শৈলী, ১ অক্টোবর ১৯৯৭, ঘ. আমাদের শিশুসাহিত্য ও জীবন–বাস্তবতা– হাসান আজিজুল হক, ঙ. সম্ভাবনার বাংলাদেশ : ছড়া –রাশেদ রউফ, বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের সেমিনারে পঠিত মূল প্রবন্ধ, চ. বাংলাদেশের ছড়ার ভূমিকা– শাহাবুদ্দীন নাগরী (বাংলাদেশের ছড়া– সম্পাদনা : আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ, শাহাবুদ্দীন নাগরী), ১৯৮৭। বাংলা ছড়ার ওপর শাহাবুদ্দীন নাগরীর প্রবন্ধটি (১৯৪৭–১৯৮৭) হলো বাংলাদেশের ছড়ার ওপর প্রথম দীর্ঘ গবেষণামূলক রচনা, যা পরবর্তীকালে আমাদের ছড়াসাহিত্যে রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
নিজের কথা একটু বলি, আমি আমার প্রধান চর্চিত মাধ্যম কিশোরকবিতা নির্মাণের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে শিশুসাহিত্য গবেষণায় ব্রত আছি দীর্ঘদিন ধরে। সেই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হয়েছে আমার কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ। সেগুলো হলো: বাংলাদেশের ছড়া : রূপ ও রূপকার– রাশেদ রউফ (প্রকাশক :বইপত্র, ঢাকা), ২০০৭, আমাদের শিশুসাহিত্য : ছন্দোময় সোনালি রেখা– রাশেদ রউফ (প্রকাশক : চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা), ২০১৬, বাংলাদেশের কিশোরকবিতা : গতিপ্রকৃতি ও অগ্রগতি (প্রকাশক : ইন্তামিন প্রকাশন, ঢাকা), ২০১৮ ও শিশুসাহিত্য ও আমাদের দায়বদ্ধতা – রাশেদ রউফ (প্রকাশক : চন্দ্রবিন্দু, চট্টগ্রাম), ২০১৯।
শিশুসাহিত্যিক হিসেবে যতটুকু পারি, আমি চেষ্টা করছি, আমার কাজগুলো যেন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। আমার গৌরব এখানে যে, আমিও অনেকের মতো একাত্তর–পরবর্তী প্ল্যাটফর্মে শিশুসাহিত্যচর্চায় শামিল হয়েছি। আমি মনে করি, শিশুসাহিত্য রচনায় যেমন নতুন নতুন মুখ সংযোজন হচ্ছে, তেমনি গবেষণায় আরো অধিক মনোযোগী হওয়া দরকার। শিশুসাহিত্য গবেষণাতেও যুক্ত হোক নতুন মেধাবী মুখ।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো, বাংলা একাডেমি।