চট্টগ্রামের কাট্টলী গ্রামের নাজীর বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ৭ জানুয়ারি ১৯০৮ সালে মাহমুদুন্নবী চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাদেম আলী চৌধুরী, মাতার নাম আফনাতুন্নেসা চৌধুরী। মাহমুদুন্নবী চৌধুরীর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ফলে তাঁর শৈশব জীবন খুবই অভাব ও দৈন্যতার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়। মাহমুদুন্নবী চৌধুরী চট্টগ্রাম কলেজ হতে ১৯৩৪ সালে বিএসসি পাশ করেন।
লেখাপড়ার পাঠ শেষ করে নবী চৌধুরী কলিকাতায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘কলম্বো মৌলানা স্টোরস’ এ চাকরি শুরু করেন। একজন সৎ ও আদর্শবান ব্যক্তি হওয়ার সুবাদে চাকরিতে তিনি সফলতা দেখান। দরিদ্রতাকে জয় করে অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলিকাতায় ছোট করে ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসা তাঁর উন্নতি ও অগ্রগতির সোপান তৈরী করে। তাঁর মাতৃভক্তি ছিল এক অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি তাঁর মায়ের আদেশ ছাড়া এবং মায়ের বিনা অনুমতিতে কোনও কাজই আরম্ভ করেননি। তাঁর মায়ের প্রতি ভালোবাসার ফলে মায়ের দোয়ায় নবী চৌধুরীর জীবনের সফলতার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করতেন। যা সমাজের জন্য এবং মানব সন্তানের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ। এরি মাঝে তিনি মেহেরুন্নেছা বেগম চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কলকাতা হতে ব্যবসাপাতি গুটিয়ে তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। চট্টগ্রামে এসে নবী চৌধুরী চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় ‘নবী স্টোরস’ নামে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। সে সময়কালে আন্দরকিল্লার ‘নবী স্টোরস্’ খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। এ ব্যবসায় তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। অর্থ উপার্জনই জীবনের লক্ষ্য নয় এটি তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। এছাড়া অর্থনৈতিক দক্ষতা এবং দারিদ্রের কষাঘাত যে কত মর্মান্তিক তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। ফলে ব্যবসায়িক উন্নতির পাশাপাশি তিনি মানব কল্যাণে ব্রতী হয়ে সমাজ সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সমাজ সেবায় অবদানের কারণে ১৯৪৯ সালে নবী চৌধুরী আন্দরকিল্লা কেন্দ্র হতে পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। কমিশনার নির্বাচিত হয়ে তিনি সাধারণ মানুষের যে খুবই কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি সমাজসেবার পাশাপাশি রাজনীতির দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত সে সময়কাল আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রচারপত্র ‘সৈনিক’ পাকিস্তান সরকার যখন বন্ধ করে দেন, তখন তিনি গোপনে ‘গেস্টেইনার সাইক্লোস্টাইল মেশিন’ অনুদানে কিনে দেন। যার মাধ্যমে সে সময়ে ভাষা আন্দোলনের যাবতীয় প্রচারপত্র গোপনে ছাপিয়ে বিলি করা হতো। এখানেই তাঁর বাঙালি প্রেমের নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তিনি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেন। বাংলার প্রবাদপ্রতিম নেতা শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক নবী চৌধুরীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন ফলে ১৯৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট হতে তাঁরই একক সিন্ধান্তে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম হতে যুক্তফ্রন্ট হতে মনোনয়ন লাভ করেন। মনোনয়ন লাভ করে ১৯৫৪ সালে সে সময়ে কালের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা এম এ আজিজের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় লাভ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি এ প্রদেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আহ্বানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার পিছনে তাঁর যুক্তি ছিল যে, এদেশের নিরীহ বাঙালিরা যুদ্ধকালীন সময়ে পাক বাহিনী কর্তৃক যাতে নির্যাতিত ও নিপীড়িত না হন। পাক হানাদার বাহিনী যাতে এদেশের মানুষকে অন্যের কু–প্রচারের কোনও প্রকার ক্ষতি করতে না পারে সে দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখা। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর এ উদ্দেশ্য বলবত ছিল। তিনি যদিওবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, কিন্তু মনে প্রাণে ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।
পাক হানাদার বাহিনী যুদ্ধের প্রথম দিকে যখন কাট্টলী অবস্থান নেয়, তখন তিনি অন্যান্য এলাকার শন্তি কমিটির অন্য চেয়ারম্যানদের ন্যায় কোন বিতর্কিত ভূমিকায় নামেননি। বরঞ্চ এলাকার মানুষের প্রতি যাতে পাক হানাদার বাহিনী অন্যায়ভাবে অত্যাচার নিপীড়ন চালাতে না পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। বরঞ্চ এলাকায় তিনি স্থানীয় সকল হিন্দু, মুসলমানদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন এবং তারা সকলেই নির্ভয়ে যথারীতি গ্রামে বসবাস করেছেন। এছাড়াও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা যাতে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে এবং সহজে তাদের অভিযান পরিচালনা করতে পারে তার জন্য তিনি সকলকে তাঁর স্বাক্ষরে পরিচয় পত্র সরবরাহ করেন। নবী চৌধুরীর এ ধরনের কার্যক্রমই ছিল সরাসরি পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এক মাত্র মুক্তিকামী জনতার মুখপত্র বা কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিল ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকা। নবী চৌধুরী বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে সে সময়ে দৈনিক আজাদী পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবাদপত্র ‘দৈনিক আজাদী’র জন্য তাঁর বলিষ্ট ভূমিকা প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।
মাহমুদন্নবী চৌধুরী ৬ আগস্ট ১৯৯৫ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি সারাজীবন দেশ ও জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। বিত্ত বৈভব, রাজনীতি ও সমাজনীতি সবক্ষেত্রে একজন সফল ব্যক্তিত্বের অনুকরণীয় আদর্শ মানুষ ছিলেন তিনি। খেটে খাওয়া মানুষের নেতা হিসেবে তিনি আজীবন পরিচিত ছিলেন। এখনও এলাকার মানুষের শ্রদ্ধার ও ভালোবাসায় তিনি সিক্ত রয়েছেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী