রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা ও আত্মোপলব্ধির বিকাশ

পিংকু দাশ | মঙ্গলবার , ৫ আগস্ট, ২০২৫ at ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা পদ্ধতিকে সাধারণের মাঝে সহজলভ্য এবং ফলপ্রসূ করার জন্য মাতৃভাষার ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন কবিগুরু। দেশপ্রেম, দেশীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে আধুনিকতার সাথে যুক্ত করেছেন। তাঁর মতে শিক্ষার প্রণালী হওয়া উচিত দেশীয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আনুসঙ্গিক বিষয়ও শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত থাকবে যা একটি দেশ বা জাতিকে সসম্মানে এগিয়ে যাওয়ার মূল নিয়ামক শক্তি। তিনি এমন এক শিক্ষার কথা ভেবেছেন যা সর্বসাধারণের উপযোগী শিক্ষা অর্থাৎ সর্বজনীন শিক্ষা। যা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার।

শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে স্বদেশকে চেনাটাই জরুরি। দেশীয় ঐতিহ্য এবং চিরায়ত সংস্কৃতির পাশাপাশি বৈশ্বিক সংস্কৃতি, আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান উন্নত জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে। তিনি কোন শিক্ষাকে কট্টরভাবে গ্রহণ বা বর্জন কোনটারই পক্ষপাতী ছিলেন না। দেশকে বাদ দিয়ে যেমন বিশ্ব নয়, তেমনি বিশ্বকে আলাদা করে জাতি সার্বিক জ্ঞান ভাণ্ডারে পিছিয়ে থাকবে। কবির মতে, ‘আপনাকে ত্যাগ করিয়া পরকে চাহিতে যাওয়া যেমন নিষ্ফল ভিক্ষুকতা, পরকে ত্যাগ করিয়া আপনাকে বঞ্চিত রাখা তেমনি দারিদ্র্যের চরম দুর্গতি।’

রবীন্দ্রনাথের কাছে সবার উপর মানুষ সত্য। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ পারফেক্ট হয় এবং মনুষ্যত্ব অর্জন করে। কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদেরকে বিদ্যা, বুদ্ধির চেয়েও বেশি ব্যস্ত থাকতে অনুপ্রাণিত করে। তাই রবীন্দ্রনাথের মতে এসবের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিকাশ সাধন হবে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

শিক্ষার পাঠক্রম হিসেবে কবিগুরু যে সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, প্রভৃতি। এছাড়া ব্যবহারিক শিক্ষার পাঠক্রম হিসেবে নৃত্য, অংকন, সঙ্গীত, খেলাধুলা, ব্যায়াম, প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন।

তিনি বিশ্বপ্রকৃতি ও বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে বিচিত্র প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্য বিজ্ঞান শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকে বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে জড়িত ছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা, ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র

সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োগ করে রাশিয়া সমগ্র জাতির পথপ্রদর্শক হয়েছে। কবিগুরু সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাদর্শ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মাতৃভাষার উপর জোর দিতে গিয়ে কবিগুরু বলেছিলেন, মাতৃভাষা হল মাতৃদুগ্ধের সমান। অর্থাৎ তিনি মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সহিত তুলনা করেছেন। ‘শিক্ষার হেরফের’ এ কবি মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন ইংরেজি হল কাজের ভাষা, মাতৃভাষা হল ভাবের। সেই ঘোরতর ইংরেজি চর্চার যুগেও রবীন্দ্রনাথের সেজ দা মনে করতেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ভিতটা পাকা করে তোলা দরকার। শিক্ষার্থীর মাতৃভাষার মাধ্যমে মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদানের কথাও বলেছেন কবিগুরু।

শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এই সময় শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তিনি বিদ্যালয়ের সংকীর্ণ পরিধির পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে শিক্ষাকার্যকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাধীন পরিবেশ নিশ্চিতে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষার আয়োজন হবে শিক্ষার্থীদের নিকট আনন্দদায়ক, মনোমুগ্ধকর। শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টিকে বাধ্য মনে না করে। মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি শিক্ষার্থীর মনের ও ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে।

স্ত্রী জাতির শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ‘স্ত্রীশিক্ষা’ নামক প্রবন্ধ লিখেছিলেন কবিগুরু। জানবার যোগ্য যা কিছু সবই যেহেতু বিদ্যা, তাই স্ত্রী পুরুষ সকলকেই তা অর্জন করতে হবে। প্রবন্ধের শুরুতেই কবি শ্রীমতী লীলা মিত্রের একটি চিঠির কথা তুলে ধরেছেন। নারীকে শিক্ষা না দেওয়ার ব্যাপারে পুরুষের দুটি সুদৃঢ় অভিমতের কথা চিঠির প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে।

নারীর যে পুরুষের মত ব্যক্তিত্ব আছে, সে যে অন্যের জন্য সৃষ্ট নয়, তার নিজের জীবনের যে সার্থকতা আছে তা কেউ বুঝতে চান না।

রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হলো পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সার্থক অভিযোজন করা। শিক্ষার্থীদের স্বাধীন ও স্বাভাবিক পরিবেশে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা দান করা। শিক্ষক হবে সহানুভূতিশীল এবং নমনীয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সর্বদা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষা দান করবেন। তাঁর শিক্ষা দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্বজনীনতা। তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয় সীমারেখার বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, যেখানে বিশ্ব সংস্কৃতির মিলন ঘটবে। আমাদের সুখেদু:খেসংকটে কবিগুরু প্রবলভাবে উপস্থিত। কবিগুরুর শিক্ষা ভাবনা তাঁর সময়ের চেয়েও বেশি অগ্রসর ছিল। মুখস্থবিদ্যা বর্জন, মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানার্জনের সঙ্গে প্রকৃতি ও আনন্দের মেলবন্ধন করা সর্বোপরি একটি বাস্তবসম্মত, শৈল্পিক শিক্ষাপ্রণালী ভারতবর্ষে বাস্তবায়ন করাই ছিল কবিগুরুর সারা জীবনের ব্রত। যা আজও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক।

লেখক: প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, হাজী নূরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কিছু কটূ বাক্য ও কিছু তথ্য
পরবর্তী নিবন্ধমাহমুদুন্নবী চৌধুরী স্মরণে