হালার পোয়া হালা (শালার পুত শালা) এ বদ বাক্যগুলো শুধু অশিক্ষিত সাধারণ জনগণই যে ব্যবহার করে তাই না সর্বশ্রেণির চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত ঝগড়া বিবাধ, ক্রোধান্বিত, উত্তেজিত কিংবা রাগান্বিত অবস্থায় অনেকের মুখ থেকে এসব বদ বাক্য কিংবা কটু বাক্য প্রতিপক্ষের প্রতি প্রক্ষেপিত হয়। শালার ছেলের ছেলে হওয়ার কথা ভাগনে কিংবা ভাতিজা, সে শালা হয় কী করে, এটা একেবারে বেমানান একটি উচ্চারণ যার কোন ব্যাখ্যা নাই। ‘মারি তোঁওরা ফাডাই দিয়ুম’ (মেরে মুখ ফাটিয়ে দেবো) এটাও একটা বদ শব্দ যা গালির অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া এমন কিছু বদ শব্দ বা গালি আছে যা অশ্লীল শব্দের সমাহারে গঠিত যা উল্লেখ করার মত রুচি বা ইচ্ছা আমার নাই। তবে শ্রাব্য যে সব কটু বা বদবাক্য সচরাচর এ অঞ্চলের মানুষের মুখে শোনা যায় তার কিছু উল্লেখ করার চেষ্টা করবো। অতি রাগত স্বরে কেউ কেউ বলে ‘বেশি ন মাতিছ, গেঁডি মোছরি দিয়ুম’ ( বেশি কথা বললে ঘাড় মটকে দিব) এছাড়া কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায় ‘চোয়ারাই দাঁত ফেলাই দিয়ুম’ (থাপড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো), তেমনি ‘টোডলা চিবি দিয়ুম’ (গলা চিপে দেবো), ‘তোর ডইল্যা খান্ডাস ন দেখি’ (তোর মত অপদার্থ দেখি নাই) ‘ন ফেরফেরা’ (বক বক করিস না) ‘দুরুই যা, তোরে দেইলে আঁর গিনে পেট ফাডি যার’ (দূর হয়ে যা, তোকে দেখলে ঘৃণায় আমার পেট ফেটে যায়) আর ‘একবার মাতিইলে হাত টেং বাঁই আঁতুর গরি দিয়ুম’ (আর একবার কথা বললে হাত পা ভেঙে পঙ্গু করে দেবো) ‘এন্ডে কিল্লাই আইচস দে, কেলা পাইক্কেনা’ ( এখানে কেন এসেছিস, কলা পেকেছে বুঝি ) ইত্যাদি।
সারা বিশ্বের বেশি কথা বলা হয় যে সব ভাষা তার মধ্যে ১০০ তম এর মধ্য স্থান পেয়েছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। সম্প্রতি বিজুয়াল ক্যাপিটালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে গবেষকরা বলছেন প্রমিত ভাষার ব্যবহার আর সচতেনতা ও চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এ ভাষার কথ্য অনেক শব্দ, লুপ্ত হতে চলেছে এর ঐতিহ্য ও গুরুত্ব। বর্তমান বহুল প্রচলিত বিশ্বের ৭১১১ টি ভাষার জরিপ প্রকাশ করে বিজুয়াল ক্যাপিটাল, এতে বিশ্বের ১ কোটি ৩০ লাখ ভাষাভাষীর মধ্যে চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষার অবস্থান ৮৮ তম। গবেষণার ভিত্তিতে জানা যায় চাটগাঁইয়া ভাষার গোড়া পত্তন বাংলা ভাষার সমসাময়িক। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ৭০% শতাংশ শব্দই আর্য ভাষা, বাকী ৩৫% শতাংশ শব্দ অনার্য ভাষা। এ অনার্য ভাষার শব্দগুলো অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার বিভিন্ন স্তরে স্থান লাভ করলেও অধিকাংশ শব্দ চাটগাঁইয়া ভাষাতে ঠাঁই পেয়েছে।
শুধু যে চট্টগ্রামের লোকেরা চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে তাই না, পার্শবর্তী মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কথ্য ভাষাও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ডুপ্লিকেট। ২০১৭ সালে কক্সবাজারে যখন রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে আসে তখন ত্রাণ কাজে অংশ নিতে আমি বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছিলাম। এদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মনেই হয়নি এরা অন্য কোনো দেশ থেকে এখানে এসেছে। আমাদের গ্রামে গঞ্জের সাধারণ মানুষদের মত চালচলন, কথাবার্তার ঢং এসব দেখে আমার মনেও হয়নি ওরা মায়ানমারের অধিবাসী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচুর আরবী, ফার্সি, পর্তুগীজ ও তুর্কী শব্দের সমাহার ঘটেছে যার ফলে এ ভাষা লাভ করেছে ভিন্ন মাত্রা। আমি শুধু সংক্ষিপ্তভাবে কিছু কটু বাক্য বা বদ বাক্যর অবতারণা করলেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অনেক ছড়া, গান, নাটক ও কৌতুক রয়েছে যা এতদঅঞ্চলের মানুষের বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে। শীত মৌসুমে জেলার বিভিন্ন স্থানে বসে কবি গানের আসর, এছাড়াও আঞ্চলিক ভাষায় পুঁথি পাঠের জলসা চলে গ্রামে গঞ্জের বাড়ির উঠোনে। সাধারণ মানুষের সাথে ঘরের বৌ ঝি রা দারুণ উপভোগ করে এ ধরনের অনুষ্ঠান সমূহ। এ ধরনের কৃষ্টি–সংস্কৃতি ও শিল্পের ব্যাপক প্রসারের জন্য চর্চা হওয়ার দরকার। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ এগিয়ে এলে হারিয়ে যেতে বসা এ শিল্প আরও সমৃদ্ধ ও উৎসাহিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। এ শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পীদের জীবন জীবিকার পথ প্রসারিত হবে, বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পাবে তারা।
বাংলাদেশের অন্য জেলার চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা এ ভাষার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি সংগঠন কাজ করছে যেমন চাটগাঁ ভাষা পরিষদ, চাটগাঁইয়া নওজোয়ান ইত্যাদি। এছাড়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বেশ কয়েকটি অনলাইন টিভি চালু আছে। চাটগাঁইয়া ভাষা আমার প্রাণের ভাষা, আমি অন্তর থেকে ভালোবাসি আমার এ কথ্য ভাষাকে।
লেখক: সভাপতি, নবীন মেলা।