প্রথম সাক্ষ্য দিলেন গুলিবিদ্ধ খোকন চন্দ্র, চাইলেন হাসিনার বিচার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

| সোমবার , ৪ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ খোকন চন্দ্র বর্মণ সাক্ষ্য দিতে এলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। নিজের ক্ষতিগ্রস্ত মুখমণ্ডল দেখিয়ে ক্ষমতাচ্যুত শাসক শেখ হাসিনার বিচার চাইলেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গতকাল রোববার শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবিলিটি এবং জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে। এ মামলায় কারাগারে থাকা একমাত্র আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করার শর্তে তার রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেছে ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজ সোমবার দিন রেখেছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় দমনপীড়নের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, তার মধ্যে এই প্রথম কোনো মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলো। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানও এদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের সামনে সূচনা বক্তব্য শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ব্যক্তি নয় অপরাধই মুখ্য। ব্যক্তি যেই হোক, অপরাধ করলে তার বিচার করার জন্য আমরা সংকল্পবদ্ধ। যে কারণে আমরা বিচার চাই। আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। পৃথিবীর ইতিহাসে শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচারের জন্ম হয়নি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার। খবর বিডিনিউজের।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা চাই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই বিচার একটি মানদণ্ড হয়ে থাকবে। আমরা চাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যাতে কোনো ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে বিচার না হয়।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সূচনা বক্তব্যে বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে বিচার পরিচালিত হবে। শেখ হাসিনার বিচার অতীতের হিসাব মেটানো নয়, এটি বিচার ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপনের একটি প্রক্রিয়া।

প্রথম দিন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন ২৩ বছরের যুবক খোকন চন্দ্র বর্মণ, যিনি আন্দোলনের মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে তার বাঁ চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়, নাক ও মুখমণ্ডল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে চিকিৎসার পর তাকে রাশিয়াতেও পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য।

ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে খোকন বলেন, ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় যে ছাত্র আন্দোলন হয়, সেই আন্দোলনে তিনি যোগ দেন। সেখানে স্লোগান দিয়ে সারাদিন আন্দোলন করে বাসায় ফিরে যান। পরদিন ১৯ জুলাই আন্দোলনে বের হয়ে তিনি ভুঁইঘর থেকে জালকুঁড়ির দিকে যেতে চাচ্ছিলেন। তবে যেতে পারেননি। পথে পুলিশ ও বিজিবি গুলি করে।

তিনি বলেন, তার চোখের সামনে আন্দোলনরত একজনের বুকে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। সাথে সাথে তিনি মারা যান। আরও অনেকে আহত ও নিহত হন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত আন্দোলনে যোগ দেন।

৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে আন্দোলনে যোগ দিতে সাইনবোর্ড মোড়ে যাওয়ার কথা সাক্ষ্যে বলেন খোকন। তিনি বলেন, সেখানে অনেকক্ষণ স্লোগান দেন তিনি, মিছিলে অংশ নেন। পরে সেখান থেকে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বেলা ১২টাসাড়ে ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পৌঁছালে তাদের ওপর গুলি করা হয়।

খোকন বলেন, তারা সামনে না গিয়ে ‘স্বৈরাচার, ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। পরে আবার যখন সামনে এগোনোর চেষ্টা করেন, পুলিশ আবারও গুলি করে। একজনের মাথায় এক পাশ দিয়ে গুলি লেগে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এমনভাবে রক্ত বের হচ্ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল গরু জবাই করা হয়েছে। ওই গুলিটা আরেকজনের গায়ে লাগে এবং সেও আহত হয়। যার মাথায় গুলি লাগে সে মারা যায়।

সাক্ষ্যে এই যুবক বলেন, তখন সেনাবাহিনী এসে ফাঁকা গুলি করে এবং পুলিশকে থানায় চলে যেতে বলে। পুলিশ সদস্যরা যাত্রাবাড়ী থানায় চলে যায়। তারপর তারা সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে স্লোগান দিতে থাকে। ওই সময় তারা খবর পান, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তখন সেখান থেকে সেনাবাহিনীও চলে যায়।

খোকন বলেন, সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর থানা থেকে পুলিশ বেরিয়ে এসে তাদের ওপর পাখির মতো গুলি করতে থাকে। তারা যে যেখানে পারেন আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি এবং কয়েকজন যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের পেছনে লুকান। তিনি বলেন, এক পর্যায়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে তাদের টার্গেট করে গুলি করে। সেখানে যারা ছিলেন অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হন। একপর্যায়ে তিনি ফ্লাইওভারের নিচে থাকা ড্রামের পেছনে আশ্রয় নেন। সেখানে একজন পুলিশ তাকে দেখে মাথা নিশানা করে গুলি করেন। সেই গুলি লাগে তার মুখমণ্ডলে। গুলি লাগার পর ছটফট করছিলেন জানিয়ে খোকন বলেন, তার আর বাঁচার আশা ছিল না। এ সময় মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে ট্রাইব্যুনালে নিজের ক্ষতিগ্রস্ত চেহারা দেখান খোকন।

তিনি বলেন, তার চিৎকারে ছাত্ররা এগিয়ে এসে তাকে ধরে ওঠায়। তার পকেট থেকে ফোন বের করে পরিবারকে খবর দেয়। তাকে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে অবস্থা খারাপ দেখে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে খোকনকে পাঠানো হয় মিরপুর ডেন্টাল হাসপাতালে। চিকিৎসা নিয়ে নতুন জীবন ফিরে পান এই যুবক।

খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ১০ দিন পর তাকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অনেকদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যে ১০ দিন আইসিইউতে ছিলেন। তার চিকিৎসা শেষ হয়নি এবং এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় পাঠায়। ৭ এপ্রিল দেশে ফেরেন তিনি। এদেশে তার চিকিৎসা নেই জানিয়ে খোকন আদালতে বলেন, আগামী ১২ আগস্ট চিকিৎসার জন্য আবার রাশিয়ায় যাবেন। ১৮ আগস্ট অপারেশন শুরু হবে।

আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ওবায়দুল কাদের, শামীম ওসমানের বিচার চার খোকন চন্দ্র বর্মণ।

সাক্ষ্য শেষে পলাতক দুই আসামি শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে তাকে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এ আইনজীবী দাবি করেন, পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করেনি। বরং আন্দোলনকারীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, দেশীয় অস্ত্রে নিজেরা আহত এবং নিহত হয়েছেন। তখন খোকন চন্দ্র বলেন, এটা সত্য না।

আইনজীবী দাবি করেন, ওই ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেররা দায়ী নন। খোকন সত্য গোপন করে অসত্য জবানবন্দি দিয়েছেন। তখন খোকন বলেন, সত্য জবানবন্দি দিয়েছি। সাক্ষ্য ও জেরা শেষে আদালত পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য আজ সোমবার দিন রেখে শুনানি মুলতবি করে।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এ মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ও জাতীয় দৈনিকের এক সম্পাদকসহ ৮১ জনকে এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাপ্তাই হ্রদের ১৬টি জলকপাট খুলতে পারে আজ বিকালে
পরবর্তী নিবন্ধব্যক্তি করদাতাদের আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দাখিল বাধ্যতামূলক