স্বাধীনতা পরবর্তী চট্টগ্রাম শহরে আমাকে প্রায় আসতে হতো। গহীরা থেকে চট্টগ্রাম ১৬ মাইল। রাঙ্গামাটির বাসে সিনেমা প্যালেস। চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম নাজিরহাট বাসস্ট্যান্ড। বাস ভাড়া আসা যাওয়া দুই টাকা। ১০ টাকা হলে ইসলামিয়া হোটেলে বিরানি সাথে সিনেমা দেখা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা এইভাবে চলছিল আমাদের কৈশোর জীবন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে বিশ্ববিদ্যালয় বাসে শহরে আসা এক বিচিত্র ব্যাপার। আসা যাওয়ার পথে যাকে উপলক্ষে করে লেখা একটি ছোট্ট বালক তার মুখের কিছু অংশ নেই, মাথাটি বড়, কী অসুখে যেন মুখের সমস্ত মাংস চলে গেছে।
রাঙ্গামাটির বাসে উঠেই তার ছোট হাত পেতে দিত। প্রথম বারে তাকে ভিক্ষা দিতে হতো, দ্বিতীয়বার সে নিতো না। দ্বিতীয়বার যারা দিতে চাইতো তাদের আক্ষেপ করতে শুনেছি সে নিলো না কেন। এইভাবে চলছে জীবন বহতা নদীর মতো। ছেলেটি চাইলে আমি তাকে টাকা দিতাম। এইভাবে তার সাথে একটি সখ্যতা গডড়ে উঠেছিল। আস্তে আস্তে সে বড় হল। আমরাও বড় হয়ে গেলাম।
আমি কাস্টমসে ঢুকলাম। নিউমার্কেটে আমাদের কাস্টম অফিসারের আড্ডা। মাঝে মাঝে তার দেখা পেতাম। তাকে দেওয়ার অংকটাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ছোট বালকটির সাথে এবং তার কৈশোরে তার যৌবনে এভাবে দেখা সাক্ষাৎ যখন চলছিল আমি তখন ঢাকা কাস্টমস বদলি হয়ে গেলাম।
হাজার ভিড়ের মাঝে সেই চেনা মুখটি হারিয়ে গেছে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা হয় না। পারিবারিক কোনো কাজে আসা হয়। একবার তাকে বিপনী বিতানে দেখা পেলাম। আমাকে দেখে সে চিৎকার করে উঠলো, বলল স্যার আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ কলোনিতে সেখানে মানুষের মাঝে আমার প্রিয় মুখটি খুঁজেছি, আপনার নাম জানি না, তারপরও চেহারার বিবরণ দিয়ে স্যার আপনাকে চেয়েছি আমি পাইনি। আজ পেলাম। সেই তার সাথে আমার শেষ দেখা। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। কানাডা আমেরিকায় পাঁচ বছর ছিলাম। আবার দেশে এসেছি।
পৃথিবী বদলে গেছে, প্রকৃতি বদলে গেছে। মানুষ বদলে গেছে জেকে টাওয়ারে আছি। একটি রুমে এসি আছে, একটি রুমে নেই। একটি বিয়েতে আমরা এসেছি চট্টগ্রামে ঢাকা থেকে। কৌতূহল বশতঃ সামনে রাইফেল ক্লাবে ইলেকট্রনিক্স মার্কেটে এসি দেখতে গেলাম। পাশে হাসান ইলেকট্রনিক। আমার পরিচিত আপনজন। দীর্ঘদিন দেখা নেই। উঁকি ঝুঁকি মারলাম দেখা যায় কিনা।
দুইতালায় এসি দেখে নিচে নামছি। হঠাৎ দেখলাম একটি বৃদ্ধ ভিখারি, মাথাটা দেখে বড় চেনা মনে হল। ইলেকট্রনিক দোকানে ভিক্ষা করছে। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আজ প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেছে। তার সাথে দেখা। আমি পিছনে দৌড়ে তাকে ধরলাম।
আমি চিনতে পারলাম সেই বিশাল মুখের ক্ষত, কোটরা গত দুইটি চক্ষু। আমি বললাম তুমি আমাকে চিনতে পারছো। তার চোখ বোধ হয় অন্ধ। তবু একটি হাত দিয়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
ভাবলাম কী দেব থাকে। আমার পকেটে ৫০ টা ৫০০ টাকার নোট আছে। গ্যাসের বিলের টাকা, অনেকদিন দেওয়া হয়নি, তাই পকেটে ছিল। সেই চেনা মুখটি। গতকাল আসার সময় চৌদ্দগ্রামের হাইওয়ানে পরিবারের সদস্যকে নিয়ে ৩০০০ টাকা বিল দিয়েছে কী খেলাম। ছোট মেয়ে আবদার ধরেছিল খিচুড়ি খাবে। কত সহজে টাকাটা দিয়ে দিয়েছি। আজ আমার সামনে দাঁড়ানো হারিয়ে যাওয়া সেই বালক সেই কিশোর, সেই যৌবন, এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছে।
তার হাতে ৫০০ টাকা গুঁজে দিলাম। তাকে বললাম তোমাকে ৫০০ টাকা দিলাম। একটু করে তাকালো। জানি না সে চিনতে পারছে কিনা তার হারানো মানুষটিকে। মনে বড় সান্তনা আমি তো চিনতে পেরেছি।
জানি না আর দেখা হবে কিনা। খুব গরম পড়ছে। বৃষ্টি হতে পারে। একটি সুখ স্মৃতি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। সেই আমার অনেক দিনের চেনা মুখটি পৃথিবীর মাঝে আবার হারিয়ে গেল।