চট্টগ্রাম নগরের লালদীঘি মাঠ এখন সবুজে ভরা এক ভিন্ন জগৎ। পুরো মাঠজুড়ে বসেছে বৃক্ষমেলা। সারি সারি দোকানে নানা জাতের গাছের পসরা বসেছে। ফুল গাছে ফুল ফুটেছে, ফল ধরেছে ফল গাছে। মাঠে প্রবেশ করে বাম দিকে একে একে দোকানগুলোতে বৃক্ষের এমন সমাহার যে কারো মন ভালো করে দিবে। ফল, ফুল, বনজ, ঔষধি–সব ধরনের গাছের সমারোহে মুখরিত হয়ে উঠেছে ১৫ দিনব্যাপী এ বৃক্ষমেলা। সাধারণ গাছ থেকে শুরু করে দুর্লভ বনসাই, ক্যাকটাস সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে এখানে। প্রতিদিন মানুষ আসছে, ঘুরে দেখছে এবং কিনছে গাছ। এ যেন সবুজের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও কৌতূহলের প্রতিফলন। এই মেলা মানুষের মনে সবুজ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং গাছ লাগানোর প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তুলবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত ২৮ জুলাই শুরু হয়েছে এ মেলা। চলবে আগামী ১১ আগস্ট পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা বয়সী মানুষের ভিড়ে জমজমাট থাকে মেলার প্রাঙ্গণ। এই মেলায় যেমন দেখা মেলে চিরচেনা দেশি গাছের, তেমনি স্থান পেয়েছে নানা প্রজাতির বিদেশি গাছও। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাস, বনসাই এবং এয়ার প্ল্যান্ট মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নজর কাড়ছে। মেক্সিকোর গোল্ডেন ব্যারেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস সাজানো আছে সারিবদ্ধভাবে। এর মধ্যে গ্রিন–বি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১২০ প্রজাতির ক্যাকটাস নিয়ে এসেছে। সবার নজর কাড়ছে এ স্টলটি। স্টল ঘিরে ভিড় করতে দেখা গেছে দর্শনার্থীদের। গ্রিন–বি এর কর্ণধার অর্ক আকিব জানান, শখের বসে শুরু করা এই কাজ এখন তার নেশায় পরিণত হয়েছে। তিনি মূলত অনলাইনে ক্যাকটাস বিক্রি করেন এবং মেলায় এসে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। মেক্সিকোর গোল্ডেন ব্যারেল, ম্যামেলারিয়া হান্নিয়ানা–এর মতো ছোট–বড় ক্যাকটাসগুলোর দাম ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। মেলায় আরেক আকর্ষণ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের বনসাই। জান্নাত শপ ডট সিটিজি নামের একটি দোকানে রাখা হয়েছে ৪৪ বছর বয়সী একটি বনসাই, যা চীনা বটগাছ হিসেবে পরিচিত। মাত্র আড়াই ফুট উচ্চতার এই গাছটির দাম হাঁকা হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ১৯৮১ সালে ভারত থেকে আনা এই গাছটি দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিকভাবে পরিচর্যা করা হচ্ছে। এ স্টলের মালিক আত–তাওয়াবুল ইসলাম জানান, এটি মূলত সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যই কেনা হয়। বিশেষ করে যারা ছাদবাগান করেন, তাদের কাছে এর কদর বেশি। এই স্টলে আরও রয়েছে ১৬ বছর বয়সী তেঁতুল গাছের বনসাই, যার দাম ৫০ হাজার টাকা এবং ৯ বছর বয়সী পাকুড় গাছের বনসাই যার দাম ১০ হাজার টাকা। এছাড়া ৫০০–এরও বেশি বনসাই নিয়ে এই স্টলটি মেলায় এসেছে।
এই মেলায় শুধুমাত্র সৌখিন গাছই নয়, রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফলদ গাছও। চিটাগং নার্সারিতে থোকায় থোকায় বাদামি খোসার লংগান দেখা যায়, যা গোল লিচু নামেও পরিচিত। এই গাছগুলোর দাম ২০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এখানকার মালিক মো. রাসেল জানান, ফুল ও ফলের প্রচুর দেশি–বিদেশি প্রজাতি তারা মেলায় নিয়ে এসেছেন। শুধু লংগানই নয়, এখানে হরীতকী, আমলকী, বহেরা, মাল্টা, কমলা–সহ দেশি–বিদেশি নানা ধরনের ফলের গাছও মিলছে। বনজ গাছপ্রেমীদের জন্যও রয়েছে নানা বিকল্প। বাহাদুর নার্সারি, বাংলাদেশ নার্সারি ও ফতেয়াবাদ নার্সারির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বনজ গাছের চারা পাওয়া যাচ্ছে। এই চারাগুলোর দাম শুরু হয় ৫০ টাকা থেকে। পাশাপাশি, ফুলের মধ্যে কামিনী, শিউলি, গন্ধরাজ, গাঁদা, সূর্যমুখীসহ বিভিন্ন দেশি–বিদেশি ফুলের চারাও মেলায় আছে।
আগ্রাবাদ থেকে মায়ের সাথে এসেছেন স্কুল শিক্ষার্থী আহনাফ হাসান। মেলায় ঘুরে কিনেছেন ছাদ বাগানের জন্য কয়েকটি ফল ও ফুলের চারা। এরকম অনেককেই ছাদ বাগানের জন্য ফুল ও ফল গাছ কিনতে দেখা গেছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় দেখা মেলায় মানুষের ভিড়। ছুটির দিন হওয়ায় অনেকে বৃক্ষমেলায় এসেছেন। ঘুরে দেখার পাশাপাশি অনেকেই কিনছেন গাছের চারা। আবার অনেকে লাগানোর মতো জায়গা না থাকায় শুধু ঘুরেই দেখতে এসেছেন। মেলায় ঢুকতেই দেখা স্কুল শিক্ষক ফারুক আহসানের সাথে। তিনি বলেন, বৃক্ষমেলা হচ্ছে শুনে দেখতে আসলাম। আমাদের চারপাশে প্রতিবছর যে পরিমাণ গাছ কাটা হয় সে পরিমাণ গাছ রোপণ করা হয় না। আর শহুরে জীবনে চাইলেও বৃক্ষ রোপণ করার সুযোগ নেই। কিন্তু যাদের সুযোগ আছে তারা লাগান না। তিনি বলেন, এখানে অনেক নতুন নতুন প্রজাতির গাছ দেখতে পেলাম, যেগুলো সচরাচর দেখা যায় না। এখানে এসে অনেকে নতুন গাছের সাথে পরিচিত হতেও পারবেন–এটা দারুণ একটি উদ্যোগ। আশা করি এরকম আয়োজন প্রতি বছর হবে। বন বিভাগ এই মেলার মাধ্যমে মানুষকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করছে বলে জানা গেছে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম কায়চার জানান, প্রতিবছর এই মেলা মানুষকে গাছের চারা লাগাতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি আশাবাদী, এবারও বিপুল সংখ্যক মানুষ মেলায় আসবেন এবং গাছ কিনে সবুজায়নে অংশ নেবেন।