(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হোটেলের রিসিপশনে গিয়ে লাগেজের তালা কেটে ফেলার পর অনেকটা নির্ভার হয়ে রুমে ফিরলাম। বিজয় দা ওয়াশরুমে। ভাবলাম যে, আমার লাগেজের কি হবে সে চিন্তায় বসে না থেকে ফ্রেশ হতে ঢুকে তিনি বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করলে এখন সিরিয়ালে পড়তে হতো। আমাদের দু’জনকে একই রুমে থাকতে দেয়া হয়েছে। ট্যুর অপারেটরই খরচ সাশ্রয়ের জন্য এমনতর ব্যবস্থা করে থাকেন। এক রুমে দুইজন থাকতে কোন সমস্যা হয় না। অপরিচিত কারো সাথে রুম শেয়ার করতে কিছুটা খচখচ লাগে। তবে বিজয় দা তো আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু, আমারই লায়ন্স ক্লাবের সদস্য। আমি যখন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, তখন দুই টার্মেই বিজয় দা ট্রেজারার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিও ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই ক্লাবের সদস্য হওয়ায় আমাদের রসায়ন খুবই চমৎকার, ইতোপূর্বেও বহুস্থানে আমরা একইসাথে গিয়েছি, থেকেছি, খেয়েছি।
লাগেজের তালা কেলেংকারীর ঝামেলায় আগে খেয়াল না করলেও এখন দেখলাম যে, রুমটি বেশ বড়সড়। টুইন বেড– দুইটি আলাদা বেড, সোফা, ডিভাইন, চেয়ার–টেবিল, কফি মেকার, পানির বোতল সবই রয়েছে। দেয়ালের সাথে সাঁটানো রয়েছে আলমারি। আলমারির ভিতরে লকার থেকে শুরু করে হেয়ার ড্রায়ার পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সবই রয়েছে। বিজয় দা একটি খাটের উপর কাপড়–ছোপড় রেখেছেন, অর্থাৎ তিনি ওই বেডে থাকবেন। তাহলে অন্যটি আমার। আমি লাগেজ থেকে কাপড়–ছোপড় এবং ওষুধের ডিব্বা বের করতে করতে কফি বানানোর তোড়জোড় শুরু করলাম।
ইন্টারকম বাজছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, লায়ন ফজলে করিম লিটন ভাই ফোন করছেন। কারণ পৃথিবীর অন্য প্রান্তের এই দূর মহাদেশে আমাদের খবর নেয়ার মতো তেমন আর কেউ নেই। ‘হ্যালো’ না বলে বললাম ‘ করিম ভাই, বলেন’। তিনি হাসলেন, বললেন–সব ঠিকঠাক আছে কিনা খবর নিচ্ছি। বের হবেন? আমি তালা কাটাকুটির ব্যাপারটি বিস্তারিত জানালাম। বিজয় দা’র হালহকিকতও। তিনি ওয়াশরুম থেকে বের হলে আমি ঢুকবো, তারপর বের হবো নাকি লম্বা হয়ে ঘুম দেবো ভাববো বলে জানালাম। করিম ভাই হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিলেন।
বিজয় দা ওয়াশরুম থেকে বের হতেই কফির মগটি বাড়িয়ে ধরলাম। নিজেরটাতে চুমুক দিতে দিতে বললাম, পৃথিবীর কফির রাজধানীতে স্বাগতম! বিজয় দা হাসলেন, বললেন–আরে, ঘরের বউওতো এতো সুন্দর সময়ে কফি দেয় না। আপনি তো দারুণ কাজ করে ফেলেছেন! আমি হাসলাম। বললাম, করিম ভাই বাইরে যাবো কিনা জানতে চেয়েছেন। প্রোগ্রাম কি বলে দেন, আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।
বিজয় দা বললেন, একটা ঘুম দেবো। ঘুম থেকে উঠে লাঞ্চে যাবো। তারপর যা করার করবো।
আমারও মনে হলো এখন ঘুমানোর কোন বিকল্প নেই। ঘুমের জন্য শরীর মন কেমন যেন হু হু করে উঠলো। কখন যে মন ভরে ঘুমিয়েছি তাও যেনো মনে করতে পারছিলাম না। ঘুমের ব্যাঘাতে শরীর বিগড়ে গেলে বেড়ানোর আনন্দ পুরোপুরি মাটি হয়ে যাবে। তাই বিগড়ানোর আগে ঘুমিয়ে–টুমিয়ে শরীরটাকে লাইনে রাখা ভালো হবে। অতএব মেলবোর্ন রেও দেখা যাবে, বেড়ানো যাবে, আপাতত ঘুমিয়ে নিলেই সবদিক থেকে ভালো হবে।
বিজয়’দা ঘুমিয়ে গেছেন। ঘুমের গভীরতা বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমিও শুয়ে পড়লাম। বেডসাইড টেবিলে লাগানো সুইচ টিপে বন্ধ করে দিলাম ঘরের আলো। জানালার পর্দাগুলো বন্ধ থাকায় ঘরজুড়ে রাতের আবহ। অতএব ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম।
অনেকক্ষন এপাশ–ওপাশ করলাম, ঘুম আসছে না। অন্যরকমের উত্তেজনা শরীর মনে। অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গেছি, মেলবোর্ন শহরে শুয়ে আছি! ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম, ইচ্ছে করছিল উড়ে উড়ে বেড়াতে, চরকির মতো ঘুরতে। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত চষে ফেলতে। অথচ কী আশ্চর্য, আমি রুম অন্ধকার করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। মেলবোর্নের ঠিক কত ঘন্টা থাকবো তা নির্ধারিত। সেই নির্দিষ্ট সময়টা এভাবে ফুরিয়ে ফেলছি, নষ্ট করছি! কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, কি করা উচিত তাও।
পৃথিবীর অন্যতম একটি সেরা শহর মেলবোর্ন। শুধু অস্ট্রেলিয়ারই নয়, এটি দুনিয়ার বাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া রাজ্যের রাজধানী মেলবোর্ন। বিমানবন্দর থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছাতে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে শহরটির রাস্তাঘাট ঝকঝকে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। শহরটিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম অত্যন্ত শানদার। গত একশ’ বছর ধরে এই নগরে ট্রাম চলে। আবার নাগরিক এবং পর্যটকদের জন্য বহু এলাকাতেই ট্রাম পুরোপুরি ফ্রি। বিদেশে ফ্রি যানবাহন পাওয়া যে কি পরিমান স্বস্তির তা বলে বুঝানো অসম্ভব। বিশ–পঞ্চাশ মাইল দূরত্বের একটি পর্যটন স্পটে যেতে টেক্সি কিংবা উবারে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় তাতে বেড়ানোর আনন্দই মাঠে মারা পড়ে। তাই আমাদের মতো গরীব পর্যটকদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। আর সেটি যদি ফ্রি হয় তো এর থেকে স্বস্তির আর কি হতে পারে! এছাড়া মেলবোর্নে মেট্রো ট্রেন এবং বাসও রয়েছে।
গুগল ম্যাপে দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাওয়ার পাবলিক ট্রান্সপোর্টের পথ ঘাট দেখছিলাম। আমি বেশ স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে, আমাদের ট্যুর অপারেটর যেটুকু দেখানোর দেখাবে, বাকিটুকু পাবলিক এবং ফ্রি ট্রান্সপোর্টে সওয়ার হয়ে আমরা নিজেরাই দেখে নেবো। ট্যুর অপারেটরের প্ল্যানটিতেও চোখ বুলিয়ে নিলাম। নিজে নিজেও একটি ছক তৈরি করলাম।
ঘুমই যখন আসছে না, তখন আর সময় নষ্ট করে লাভ কি? বিজয় দা কিংবা করিম ভাই জেগে উঠা পর্যন্ত কিছু কাজ এগিয়ে রাখলে ভালো হবে। আমি শুয়ে শুয়ে মেলবোর্নের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। হোমওয়ার্ক করার মতো করে আমাদের লায়ন্সের প্রোগ্রাম, ট্যুর অপারেটরের ডে ট্যুর প্ল্যানের বাইরে নিজেরা কোথায় কোথায় যেতে পারি সেসব জায়গাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে টুকটাক নোট করে রাখার চেষ্টা করতে শুরু করলাম।
মেলবোর্নের ইতিহাস বহু পুরানো। হাজার হাজার বছর ধরে ওখানে বিভিন্ন উপজাতি এবং আদিবাসীর বসবাস। তারা এই ভূমিকে ‘বিরারুং’ বা ‘মেঘের নদী’ নামে ডাকতো। আধুনিক মেলবোর্নের গোড়াপত্তন শুরু হয় মাত্র দুইশ’ বছর আগে। ১৮৩৫ সালে তাসমানিয়ার ব্যবসায়ী জন ব্যাটম্যান এবং জন ফকনার ‘পোর্ট ফিলিপ বে’র তীরে একটি ছোট বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেন। যদিও ব্রিটিশ সরকারের চোখে ওই বসতি শুরুতে অবৈধ ছিল, তবে পরবর্তীতে ১৮৩৭ সালে লাভের গন্ধ পাওয়ার পর সরকার এটিকে স্বীকৃতি দেয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উলিয়াম ল্যাম–এর নামানুসারে শহরটির নাম রাখা হয় মেলবোর্ন। ল্যাম প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও রানী ভিক্টোরিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের ডার্বিশিয়ার মেলবোর্ন শহরের অধিপতি ছিলেন। ইংল্যান্ডের ওই মেলবোর্নের নামানুসারেই মুলত অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। শুধু মেলবোর্নই বা বলছি কেন, পুরো রাজ্যটির নামই ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ রাণীর নামে নামকরণ। অস্ট্রেলিয়ার হেথায় হোথায় হাজার হাজার ব্রিটিশ নাম দিব্যি রয়ে গেছে। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসার পথে যে পরিমান ব্রিটিশ নাম দেখে আসলাম তাতে মনে হচ্ছিলো ইংল্যান্ডেই ঘুরছি!
শুধু মেলবোর্নের নয়, অস্ট্রেলিয়ারই জয়জয়কার শুরু হয় ১৮৫০ সাল থেকে। ১৮৫১ সালে, নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে আলাদা হয়ে ভিক্টোরিয়া একটি স্বতন্ত্র উপনিবেশ হয়। ঠিক সেই বছরই ওই অঞ্চলে আবিস্কৃত হয় স্বর্ণখনি। ‘গোল্ড রাশ’ নামে পরিচিত ওই সময়কালে হাজার হাজার খনি শ্রমিক, ভাগ্য অন্বেষী, ব্যবসায়ী এবং অভিবাসী আমেরিকা, ইউরোপ, চীন এবং ভারত থেকে ছুটে আসে ভিক্টোরিয়ায়। তাদের প্রায় সবাই মেলবোর্ন শহরে এসে নামত। কেনাকাটা করত, বসতি গড়ত। এখান থেকেই খনি অঞ্চলে যেত। ফলে মেলবোর্ন হয়ে ওঠে ওই সময়কার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র, অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। ১৮৫১ থেকে ১৮৬০–এর মধ্যে ভিক্টোরিয়ায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ উৎপাদনকারী অঞ্চল হয়ে ওঠে।
অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণ অনায়াসে ব্রিটিশ অর্থনীতিতে নিয়ে আসার জন্য ১৮৭২ সালে মেলবোর্নে স্থাপন করা হয় রয়্যাল মিন্ট বা মুদ্রা তৈরির কারখানা। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত যেখানে স্বর্ণ মুদ্রাসহ ব্রিটিশদের প্রয়োজনীয় নানা মুদ্রা তৈরি এবং বিশ্বব্যাপী লেনদেন হতো। ওই সময়ে মেলবোর্নের রাস্তাঘাট, ব্যাংক, ব্যবসা কেন্দ্র, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা স্থাপনার চোখ ধাঁধানো জৌলুশ পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। ওই সময়টাকে বলা হয় মার্ভেলাস মেলবোর্ন ইরা বা বিস্ময়কর মেলবোর্ন যুগ। ওই স্বর্ণযুগেই মেলবোর্ন পৃথিবীর অন্যতম ধনী শহরগুলোর একটি হয়ে উঠে। যে জৌলুশ আজো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।