সৌন্দর্য

জয়া কথিকা | সোমবার , ২৮ জুলাই, ২০২৫ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

১৯শে এপ্রিল, ২০২৪। হঠাৎ করেই কোলকাতায় আসা। আজাদের খুব কাছের বন্ধু অশোক ভাই এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এলেন। বললাম, এবার কোন ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট নয়, একদম রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্ট হতে খাবো। কোথায় কোথায় যেতে চাই জানালাম। সেই লিস্টে প্রথম হলো, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থাপিত ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত একটি ছোট শহর বোলপুরে অবস্থিত “শান্তি নিকেতন”।

২২শে এপ্রিল, সকাল পাঁচটায় গাড়ী ছুটলো শান্তি নিকেতনের উদ্দেশ্যে। যাত্রী আমরা চারজন। আমি, আজাদ, অশোক ভাই এবং অশোক ভাইয়ের ছেলে কুনাল। পলি ভাবি কিছু কাজে আটকে গেলেন। সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছালাম, পূর্ব বর্ধমানে।। এখানের সব দোকানের ল্যাংচা খুব জনপ্রিয়। আমরা আদি ল্যাংচা ধামে থামলাম। ল্যাংচা খেয়ে সামনের অপর একটি রেস্টুরেন্টে সকালের চাবিরতি। ব্যস ন’টা নাগাদ পৌছে গেলাম, শান্তিনিকেতন।

ভাড়া করা গাড়ীটিকে অপেক্ষমান রেখে অপর একটি টেক্সি ভাড়া করলাম পুরো এলাকা ঘুরে দেখার জন্য। এই এলাকাটির পূর্ব নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। অটোতে করেই ঘুরলাম বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভবন যাদুঘর, কলাভবন, পাঠভবন, ছাতিমতলা, উপাসনা গৃহ, উত্তরায়ণ কমপ্লেক্স, সোনাঝুরি হাট, কোপাই নদী, তালধ্বজ আরো অনেক অনেক! স্থানীয় বাউল শিল্পীদের একতারার সুরে ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত, সাঁওতালি উপজাতিদের পরিবেশিত লোকনৃত্য, লুঙ্গি পাঁচি নৃত্য উপভোগ করলাম এবং আমি, আজাদ, কুনাল সেই নৃত্যে অংশ গ্রহন করলাম।

ঘোরাঘুরি শেষে খাওয়া দাওয়া। শ্যামলী, আয়োজন, শীতল কুটির, পাঁচ মেশালি ইত্যাদি বেশ অনেকগুলি নামকরা রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা সোনাঝুরি হাটের কাছেই রামশ্যাম রেস্টুরেন্টটি বেছে নিলাম দুপুরের আহার গ্রহণের জন্য। থালি হিসেবে নিরামিষ খাওয়া দেয়া হয়। ঝরঝরে ভাতের সাথে ডাল, শাক, বেগুন ভাজা, আলু পোস্ত, শুক্ত, চাটনি, পাপড়, স্যালাদ, যেকোন একটি মিষ্টি এবং পানি। এর সাথে আলাদা করে মাছ, মাংস, ডিম অন্য যে কোন কিছু নেয়া যায়। আজাদ রূপচাদা নিলো, অশোক ভাই চিকেন। আর ডিম তো পাতে থাকবেই।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই খাবার চলে এলো। একটি সাঁওতালি মেয়ে এলো খাবার পরিবেশন করার জন্য। মেয়েটিকে দেখে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মধ্যম গড়নের আকৃতি, পেটা ত্বকের রঙ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট, মাথার বাম পাশে সিঁথি কেটে টেনে খোঁপা করে রাখা কোঁকড়ানো চুল। রূপোর প্রতি সাঁওতাল নারীদের ভীষণ ভালবাসা। এই মেয়েটিও তার ব্যতিক্রম নয়। সেজেছিল রূপোয় গড়া চুড়ি, ছোট কান পাশা, আংটি এবং লকেটসহ চেইন দিয়ে। প্রসাধনী বলতে মুখে তেল বা কিছু একটা হয়তো মেখেছে। তাতেই মুখটা চকচক করছিল। এর বাইরে আর কিচ্ছু না। কোন লিপস্টিক, কাজল কিছুই ছিল না। এতটুকুতেই সামনা সামনি তাকে অপরূপা লাগছিল। আমার দৃষ্টি মেয়েটির উপর হতে সরাতে পারছিলাম না। এই সাধারণ মেয়েটিকে আমার অসাধারন সুন্দর লাগছিল। আজাদকে বললাম, মেয়েটি খুব সুন্দর, তাই না? আজাদ বললো, সুন্দর! ওর জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সুন্দর! কিন্তু সবার কাছে ওকে সুন্দর লাগবে না। আমি বললাম, কেন? কাল? একারণে? আজাদ বললো, হুম।

আমি ভাবছিলাম, আমরা সুন্দর কারে বলি? সুন্দরের সংজ্ঞা কি? শারীরিক গঠন, উজ্জ্বল ত্বক, সুন্দর চুল, এবং আকর্ষণীয় মুখের গড়ন, এগুলিই কি সৌন্দর্যের মাপকাঠি? অবশ্যই এর সাথে আরো যুক্ত হয় পোশাক ও সাজসজ্জা, আচরণ ও ব্যক্তিত্ব, স্বাস্থ্য। এছাড়া, নারীর ভেতরের গুণাবলী, যেমন আত্মবিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা, এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতি সব মিলিয়ে একজন মানুষের সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের গায়ের রঙ সাধারণত একটু কালো হয়। বিষুবরেখার কাছাকাছি অবস্থানের কারণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পেতে গায়ের এই রঙ প্রয়োজনীয়। মজার বিষয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেই সাধারণত ‘সুন্দর’ বলতে লম্বা চুল, সূঁচালো নাক এবং ফর্সা মানুষকে বোঝানো হয়। গায়ের রঙ যদি কালো হয়, তাহলে এ অঞ্চলের মানুষকে বিশেষত নারীকে সুন্দর ভাবা হয় না। সৌন্দর্য বিষয়টার সঙ্গে গায়ের রঙ যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। আমি বুঝি না, গায়ের রঙ কিভাবে সৌন্দর্যের নির্দেশিকা হতে পারে?

নিজেকে অপরের কাছে সুন্দর, আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য যুগ যুগ হতে কত না প্রাণান্তকর চেষ্টা চলে আসছে। নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দেখা যায় ফর্সা হবার বাসনা। কত কিছু শরীরে মেখে, কত রকম নিত্য নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে গায়ের রং ফর্সা, মসৃণ, উজ্জ্বল করার চেষ্টা করে চলেছে সবাই। কারণ ফর্সা ত্বককে অনেক সংস্কৃতিতেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়, যা মানুষকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। গায়ের বর্ণ ফর্সা হলে সেই মেয়েটি ছোটবেলা হতেই আত্মবিশ্বাসী বোধ করেন যা তাঁর জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ সমাজের মানুষ তাঁকে এই বোধ দেয়, তুমি সুন্দর এবং এই আচরনই তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়ার জন্য মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। অপর দিকে কাল গায়ের রং মেয়েরা ছোটবেলা হতেই হীনমন্যতা ভোগে। এই সমাজের অনেকের মধ্যেই অপর মানুষের শরীরের রং বা গড়ন নিয়ে আড়ালে অথবা প্রকাশ্য নেতিবাচক মন্তব্য করার প্রবণতা আছে। অনেকসময় এই কটূক্তি আসে পরিবার থেকেও।

কবি শামসুর রাহমান কালো মেয়ের জন্যে বলেছিলেন,

কালো মেয়ে তুমি যতই কালো হও

তোমার সত্তায় আমি দেখেছি

গীর্জার মোমবাতির আলোর মত আভা,

সে আভাকে প্রণতি জানায় এ কণ্ঠস্বর!”

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধসাজঘর নাট্যকর্মীদের জীবন ও মঞ্চসংগ্রামের নাট্যভাষ্য