দূরের দুরবিনে

বিপদকালীন ঐক্য হোক আমাদের শক্তি

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ২৮ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ

হাওয়াই দ্বীপপুন্‌েজর একটি দ্বীপের নাম বিগ আইল্যান্ড। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি সোনালী কচ্ছপ দেখার জন্য গিয়েছিলাম। রাজধানী হনলুলু থেকে একঘন্টার বিমান যাত্রা। যাবার সময় নীচে প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশি দেখে চমৎকার লাগছিল । কিন্তু আসার সময় বদলে গেছিল সবকিছু। একঘন্টার ফ্লাইটে জুশ আর বাদাম ছাড়া আর কিছু দেয়া হয় না। সেটা দিতে এসেছিলেন বিমান সেবিকা। হঠাৎ বিমান এমন দুলুনি তে পড়লো যে মনে হচ্ছিল ছিটকে পড়ে যাবে নীচে। জুশ বাদাম চারদিকে সব ছড়িয়ে পড়লো। বিমান সেবিকা ভদ্রমহিলা টাল সমালাতে না পেরে পড়ে গেলেন দুই সিটের মাঝখানে। আমাদের তো তখন হয়ে গেছে। ভাবছিলাম আমি আর দীপা দুজন ই চলে গেলে আমাদের ছেলেটি তো পৃথিবীতে একেবারে একা হয়ে যাবে। ঈশ্বর কে মাকে স্মরণ করতে করতে আমাদের সময় যেন ফুরাতে চাইছিল না। নীচে তাকিয়ে দেখলাম সেই নীল জলরাশি।

হনলুলু থেকে বিগ আইল্যান্ডে যাবার পথে যে জলরাসি ছিল স্নিগ্ধ প্রশান্ত ফেরার এই দুর্যোগকালে তাকে মনে হচ্ছিল ফণা তোলা রুদ্র সাপের মতো। পাইলট যদি বাগে রাখতে না পারতেন তাহলে সে দিন ই হতো আমাদের শেষ যাত্রা। বিমান দুর্ঘটনা বলে কয়ে হয় না, আর হলে বাঁচার চান্স জিরো। রকমভেদে বিমান ভূপাতিত হবার নানা কারণ থাকে । আমি বলছি ঢাকার মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির কথা। সামলাতে না পারা বিকল যুদ্ধবিমানটি এসে আছড়ে পড়েছিল স্কুল / কলেজ ভবনে। সে ঘটনা আপনারা সবাই জানেন। ঘটনার তিনদিন পর স্কুলের এক ছাত্রের কথা তুলে ধরছি:

আগের দুদিনের তুলনায় গতকাল বুধবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাস ও চারপাশটা তুলনামূলক শান্ত। উৎসুক মানুষের ভিড় কমেছে। যারা আসছেন, তারা বাইরে থেকেই যতটুকু পারছেন ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছেন। তবে শিক্ষকসহ বাকি কর্মকর্তাকর্মচারীরা এসেছেন স্কুলে। সেইসঙ্গে হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীসহ অন্য শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে এসেছে। অনেকের সঙ্গে তাদের অভিভাবকও এসেছেন। তেমনই একজন শিক্ষার্থী রামিম তাসকিন আহমেদ।

রামিম স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ঘটনার দিন বিমান বিধ্বস্তের পর বিস্ফোরণের ফলে লাগা আগুনের আঁচে তার এক কান পুড়ে যায়। শরীরের সেই পোড়া ক্ষত ছাপিয়ে বন্ধু হারানোর বেদনায় কাতর এই শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে দেখা হয় স্কুলের চার নম্বর ভবনের সামনে। রামিম এসেছিল ঘটনার দিন রেখে যাওয়া বইয়ের ব্যাগ নিতে। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে জানাল, ‘আমাদের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে সবাইকে বের করে দেওয়ার পরই আমি বের হই। তখনো তাই করছিলাম। খুব বেশিজন তখন সেখানে ছিল না। ছুটির পর যারা কোচিং করে এরকম চারপাঁচজন ছিল। এমন সময় টিনের ওপর আমরা একটা শব্দ শুনতে পাই। এরপর আরও একটা বিকট শব্দ।

তৃতীয় ধাপে হয় এর থেকেও বিকট শব্দ। দ্বিতীয় শব্দের পর মিনিটখানেক কালো ধোঁয়ায় সব অন্ধকার হয়ে গেল। তৃতীয় শব্দের সঙ্গেই আগুন লেগে যায়। আমি দূরে ছিলাম, সেই আগুনের আঁচেই আমার কান পুড়ে গেছে। চোখের সামনেই আমার তিন বন্ধু আগুনে পুড়ে মারা গেল। সেই দৃশ্য আর মনে করতে চাই না!’ রামিমের পাশে থাকা তার বাবা রুবেল আহমেদ সন্তানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ও ভীষণ ট্রমার (আতঙ্কে) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। আমরা ওকে ঘটনার দিন থেকে একা থাকতে দিচ্ছি না।

রামিমের সঙ্গে আরেক শিক্ষার্থী এসেছিল ক্যাম্পাসে। তার নাম জাহিদ মোল্লা। জাহিদ মাইলস্টোনের বাংলা ভার্সনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেও বাবার সঙ্গে রেখে যাওয়া বইখাতা ও সাইকেল নিতে এসেছিল। জাহিদ জানায় তার বেঁচে ফেরার গল্প। তার মতে, সেটা অলৌকিক। কারণ প্রতিদিন ছুটির সময় ঠিক সেই জায়গাটায় গিয়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে, যেখানে গত সোমবার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। আতঙ্কভরা অভিব্যক্তি নিয়ে জাহিদ বলে, ‘প্রতিদিনের মতো আমি ঠিক ওই জায়গাতেই অপেক্ষা করছিলাম। এক বন্ধু এসে আমাকে বলল, চল ক্যান্টিনে যাই। আমিও কিছু না ভেবে ওর সঙ্গে ক্যান্টিনের দিকে রওনা দিলাম। রওনা দেওয়ার বিশপঁচিশ সেকেন্ডের মাথায় বিমানটি এসে ওখানে পড়ে। আমি যে বেঁচে ফিরেছি এটা এখনো বিশ্বাস হয় না।’

এই অবিশ্বাস্য বেঁচে ফেরার গল্পগুলো আমাদের দুটি শিক্ষা দেয়।

এক) বিপদে মিথ্যা ও গুজব না ছড়ানোর। দুই) লাশ বা আহতদের নিয়ে রাজনীতি না করা। কিন্তু আমরা তা মানি না। আপনি দেশ বিদেশে এমন দুর্ঘটনার অনেক খবর দেখবেন। উন্নত দেশহলে তো এতদিনে মন্ত্রীর পদত্যাগ এমন কি সরকারেরও বারোটা বাজার কথা। কে জেলে যেতো আর কে বাইরে থাকতো বলা মুশকিল। আমাদের আশে পাশে যেসব গণতান্ত্রিক দেশ আছে তাদের দিকে তাকালেও দেখবেন হয়তো কিছু বিষয় চাপা পড়ে যায় হয়তো সর্বৈব সত্য বের হয়ে আসে না কিন্তু মোটামুটি একটা ছবি পাওয়া যায় । সে তথ্য বা ছবিতে বিশ্বাস রাখা চলে। কিন্তু আমাদের সমাজে তার বালাই নাই।

আজকাল চাইলেও সত্য বলা যায় না। গেলেও তার দায়িত্ব নেয় না কেউ। ভয়ে ভয়েই বলছি সরকার তো এই অপঘটনা ঘটায় নি। কোন উপদেষ্টা বা কেউ তো এর মাস্টার মাইন্ড নন তাহলে লুকাছাপা কেন? কেন মানুষ মৃতের সংখ্যা আহতের পরিমাণ নিয়ে নানা কথা বলছে? কেন বাচ্চারা আবার মাঠে নেমে মার খাচ্ছে? কী এক আজব সমাজ! দিন আগে যে সব বাচ্চারা এদের দেশ শাসনে আনার জন্য জান দিলো তারাই এখন লাঠির শিকার । চোখ বন্ধ করে থাকলে তো সত্য গায়েব হয়ে যায় না।

মানুষ আরো বেশী বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে রাজনৈতিক দল ও সিনিয়র নেতাদের দন্ত বিকশিত সমঝোতার মিটিং দেখে। তখন কিন্তু দেশে বিদেশে বাংলাদেশীদের চোখে কান্না। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ছিল বাঙালির আকাশ। সেখানে হঠাৎ এমন মিটিং আর খুশি খুশি ভাবের ফটোসেশন দায়িত্ববোধের অভাব তুলে ধরেছে ।

জানি না আমাদের ভবিষ্যত আসলে কোথায়? তরুণ ও নতুন প্রজন্মের ওপর যে সব দায় যে সব আগাছা আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি তারা কি এর থেকে মাথা তুলতে পারবে?

সব নেগেটিভেও কোন না কোন পজিটিভ কিছু থাকে। এই দুর্ঘটনার পর জাতি ধর্ম লিঙ্গ বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল। রক্তদান থেকে চোখের পানিতে ঐক্য গড়ে উঠেছিল বাঙালির। এই আমাদের শক্তি। অন্তত: বিপদের সময় যে ঐক্যবোধ তার ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনামহীন জলচিহ্ন
পরবর্তী নিবন্ধস্টার্টআপ: বিনিয়োগ না, বঞ্চনার আধুনিক কৌশল