যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঋণমান যাচাইকারী কোম্পানি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ঋণমান ‘স্থিতিশীল’ রেখেছে। সংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান আগের মতোই ‘বি প্লাস’ ধরে রেখেছে; একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি রেটিং ‘বি’ বহাল রেখেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসঅ্যান্ডপি আরও বলছে, গত দুই বছরে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে রাজনৈতিক ও বৈদেশিক লেনদেনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে আগামী এক বছরে প্রবৃদ্ধি আবার গতি পেতে পারে। সে ধারাবাহিকতায় পরবর্তী তিন বছরে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। এসঅ্যান্ডপি আরও জানিয়েছে, ২০২৬ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন সক্ষমতা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে ধারাবাহিক প্রবাসী আয় ও তৈরি পোশাক থেকে শক্তিশালী রপ্তানি আয়। এসঅ্যান্ডপি বলেছে, গত ১৮ মাসে নমনীয় বিনিময় হার চালু, টাকা অবমূল্যায়ন মেনে নেওয়া, কঠোর মুদ্রানীতির প্রয়োগের মতো নেওয়া সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু নীতিমালা বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য পুনর্গঠনে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির হার আরও কমে এলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে পারে।
তবে প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ককে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, এই শুল্ক কার্যকর হলে তা তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা ও শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। এসঅ্যান্ডপি বলেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখনো অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। কারণ, এখানে শ্রমের খরচ কম এবং শ্রমশক্তির সহজলভ্যতাও রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শুল্ক হার বাংলাদেশকে ওই বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে দিতে পারে।
এসঅ্যান্ডপি বলছে, গত দুই বছরে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে রাজনৈতিক ও বৈদেশিক লেনদেনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে আগামী এক বছরে প্রবৃদ্ধি আবার গতি পেতে পারে। সে ধারাবাহিকতায় পরবর্তী তিন বছরে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। এসঅ্যান্ডপি আরও জানিয়েছে, ২০২৬ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের এখনো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে এসঅ্যান্ডপি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, প্রতিষ্ঠানগত কাঠামোর পরিবর্তন, অবকাঠামোগত ঘাটতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে প্রশাসনসহ সরকারের কাঠামোতেও। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নীতিগত– এ তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। এ তিনটি ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা রাষ্ট্রের সক্ষমতা, কার্যক্ষমতা এবং জনসেবার পরিসর সংকুচিত করে তুলছে। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সরকার নয়, তাই তাদের জন্য এ সংকোচন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে নানা সংকটের মধ্যে রয়েছে সরকারের স্থিতিশীলতার অবস্থা, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ বা অবস্থা, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দুর্নীতি, ধর্মীয় অসন্তোষ ও সংঘাত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নানা সংকট, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি এবং আমলাতন্ত্রের স্বচ্ছতা। তাঁরা বলেন, সরকারের স্থিতিশীলতা নানা কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন।এমনকি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীরাও এখনও নতুন কিছু গড়ার বিষয়ে আশ্বস্ত নন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হচ্ছে। এখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের শক্তিমত্তা ও আইন প্রয়োগের সক্ষমতা ফিরে পায়নি। গণতান্ত্রিক জবাবদিহির চর্চা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। ধর্মীয় অসন্তোষ এবং সংখ্যালঘুদের এক ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অনেক কাজ ভেসে উঠছে। এসব কাজ করতে হবে দ্রুত। কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যত বাড়বে অন্তর্বর্তী সরকারের শত সদিচ্ছা থাকার পরও তা বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করার পথে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে দেশ ভোগ, উৎপাদন ও পুনর্বিনিয়োগের একটি চক্র শুরু করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য বিমোচনের পথ প্রশস্ত করবে। বাংলাদেশের জন্য এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।