পৃথিবীর খুব কম মানুষই সচেতনভাবে, দৃঢ়তার সাথে নির্যাতিত নিপীড়িত অসহায় মানুষের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন, যেভাবে ফ্রান্সেসকা আলব্যানেজ হয়েছেন। এ অর্থে পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের অসহায়ত্বে মানুষের পাশে দাঁড়ানো তিনি একজন মহৎ জন হয়ে বেঁচে থাকবেন।
ফ্রান্সেসকা আলব্যানেজ ইটালীয়ান। তিনি মানবাধিকার বিষয়ে পৃথিবীর অন্যতম একজন আইনজ্ঞ। ১ মে ২০২২ থেকে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব কর্তৃক মনোনীত হয়ে অধিকৃত প্যালেস্টাইনের জন্য বিশেষ রেপোটিয়ার বা বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ৩ জুলাই ২০২৫ জেনাভায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাউন্সিলের সভায় আলব্যানেজ অধিকৃত প্যালেস্টাইন এবং গাজার উপর তার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
বিশ্ব পুঁজিবাদের সমস্ত রক্তচক্ষুর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফ্রান্সেসকা আলব্যানেজ তার ঐ প্রতিবেদনে ইসরাইলকে ঘিরে পুঁজিবাদী বিশ্ব কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে তাদের পুঁজির বিস্তার ঘটাচ্ছে তার নির্মম চিত্র তুলে ধরেছেন। এটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘ফ্রম ইকোনমি অব অকোপেশন টু ইকোনমি অব জেনোসাইড’ হিসাবে।
আলব্যানেজ তার বক্তব্যে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে ইসরাইলের সাথে যাবতীয় বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক চিহ্ন করার আহবান জানান। যে সব দেশ ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে তাদেরকে ইসরাইলের উপর কঠোর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও আহবান জানিয়েছেন তিনি।
ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে পুঁিজবাদী অস্ত্রব্যবসায়ীরা কীভাবে অর্থের পাহাড় গড়ে তুলছে তার হিসাবও আলবেনেজ তুলে ধরেছেন। তিনি প্যালেস্টাইনের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন ‘ The situation in the occupied Palestinian territory is apocalyptic ’ অর্থাৎ ‘অধিকৃত প্যালেস্টনের অবস্থা এখন চূড়ান্ত বিপর্যয় তথা ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে’। তিনি আরো উল্লেখ করেন ‘ Israel is responsible for one of the cruelest genocides in the history ’ ‘পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম এক গণহত্যার জন্য ইসরাইল দায়ী’।
‘Weponizing hunger ’ খাদ্যকে হত্যার হাতিয়ার তথা মানুষের খাদ্যাভাবকে ইসরাইলীরা হত্যার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে। খাদ্যের জন্য অভুক্ত মানুষ লাইনে দাঁড়ায়, খাদ্যের জন্য দাঁড়ানো অভূক্ত মানুষদের এ পর্যন্ত ৭০০ (সাতশ) জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরা কত অমানবিক নৃশংস এবং হৃদয়হীন হতে পারে তার প্রমাণ খাদ্যের মাঝে মাদক মিশানো। পরিকল্পিতভাবে ইসরাইল আমেরিকা প্যালেস্টাইন তথা গাজায় অবরোধের মাধ্যমে কৃত্রিম খাদ্য অভাব সৃষ্টি করে। এরপর অভাবী মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণের দায়িত্ব জাতিসংঘ থেকে তারা কেড়ে নেয়। ফিলিস্তিনীদের হত্যার জিঘাংসা পূরনে তারা ‘ইসরাইল-আমেরিকা খাদ্য বিতরণ ফান্ড’ গঠন করে। খাদ্য বিতরণের আড়ালে ‘ইসরাইল-আমেরিকা’ এখন খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়ানো ফিলিস্তিনিদের নির্বিচার হত্যা করে চলেছে।
ইসরাইলের ফিলিস্তিনিদের ভুমি থেকে উচ্ছেদ কৌশলের নাম হল Displacement and Replacement , এর সরল অর্থ হল উচ্ছেদ কর পুনর্বাসন কর। ফিলিস্তিনিদের স্বীয় ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে র্নিবিচার ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারীদের পুনর্বাসন করা। এটি কোন ব্যক্তি করছে না করছে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্র ইসরাইল। এ পুনর্বাসনে নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা সব কিছু রাষ্ট্রই করছে। এবং এটাই Colonial Occupation and Racial Economy তথা ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব এবং জাতিগত বৈষম্যমূলক অর্থনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ঔপনিবেশিক দখলদারিত্বকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ১৯০১ সালে সদূর প্রসারী এক পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘জিউস ন্যাশনাল ফান্ড’ এ ফান্ডটি মূলত গঠিত হয়েছিল ইহুদিদের বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে জমি কেনার জন্য। এই অর্থের বিনিময়ে এবং প্রাবল্যে করপোরেট এনটিটিগুলি ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে ক্রমাগত ইহুদি বসতি স্থাপন করতে থাকে। এটি ‘নাকাবা’ থেকে রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। এখানে বিষয়টি কিছুটা আলোচনার অবকাশ রাখে। আসলে নাকাবা কী? উইকিপিডিয়ায় নাকাবাকে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে ‘ The Nakaba is the ethnic cleansing of Palestine Arabs through their violent displacement and dispossession of land, property and belongings along with the destruction of their society and the suppression of their culture, identity, political rights and national aspirations. The term is used to describe the events of 1948 Palestine war in mandatory Palestine as well as the ongoing persecution and displacement of Palestinian by Israel. ’ নাকাবা হল ফিলিস্তিনীদের জাতিগত বৈষমের শিকারে পরিনত করে প্রচণ্ড সহিংসতায় তাদেরকে তাদের বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি থেকে উৎখাতের নাম। নাকাবা হল সহিংসতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক অধিকার, জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ কারার এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা।এই শব্দটি ১৯৪৮ সালে ইসরইলীদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নির্মমতার শিকারে পরিণত করে তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের অপর নাম।
তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী বালফোর প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে বৃটিশদের সাহয্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানোর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের উপর ভবিষ্যৎ খবরদারীর জন্য ২ নভেম্বর ১৯১৭ ফিলিস্তিনি ভূ-খণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী’র নাম অনুসারে সে ঘোষণা পরবর্তীতে বালফোর ঘোষণা হিসাবে ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করে। বালফোর ঘোষণার মাধ্যমে মূলত পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলকে গর্ভে ধারণ করে। সেই থেকে ১৪ মে ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের জন্ম পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেই গর্ভস্থ সন্তানের যথাযথ পরিচর্যা করে। নাকাবা, ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরো বিধ্বংসী, আরো নির্মম এবং বিস্তৃত রূপ লাভ করে।
১৯৬৭ সালের আরব – ইসরাইল যুদ্ধ ছিল ৬ দিনের। এ যুদ্ধের মূলে ছিল মিশরের সাথে সুয়েজ খাল এবং লোহিত সাগরে ইসরাইলী জাহাজ চলাচলের ব্যাপারে বিরোধ। যুদ্ধে ইসরাইলীরা মিশর, সিরিয়া এবং জর্দানের ব্যাপক অঞ্চল দখল করে নেয়। এর মাঝে মিশরের সিনাই উপত্যকা, গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান হাইট উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৭ সালের আরব – ইসরাইল যুদ্ধে কর্পোরেট এনটিটিগুলি তাদের সমস্ত আর্থিক সামরিক শক্তি নিয়ে ইসরাইলের পাশে দাঁড়ায়। যুদ্ধ পরবর্তী এদের কর্মকাণ্ড আরো উদগ্র রূপ রাভ করে। অধিকৃত ভূমি থেকে ফিলিস্তিনীদের উৎখাতের ব্যাপক উৎসব চরম রূপ লাভ করে এই সময় থেকে।
ফ্্রান্সেসকা আলব্যানেজ এই বিধ্বংসী রূপকেই ‘ফ্রম ইকোনমি অব অকুপেশন টু ইকোনমি অব জেনোসাইড‘ অর্থাৎ ‘দখলদারিত্বের অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতি’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থা সমূহের ইসরাইলকে ক্রমাগত অস্ত্র এবং উচ্ছেদে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যোগানের মাধ্যমে সক্ষম করে তোলায় অবিরাম সাহায্যের হাত বাড়ানোর বিষয়টি আলব্যানেজ স্পষ্ট তুলে ধরেছেন।
অধিকৃত ভূমি থেকে ফিলিস্তিনীদের উৎখাতের ব্যাপক উৎসব তাদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা ‘ইন্তিফাদা’র ডাক দেন এবং ব্যাপকভাবে এতে অংশগ্রহণ করেন। সম্প্রতি আমেরিকান ডেমোক্রেটিক পার্টি মনোনীত নিউইয়র্কের মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানী বিশ্বব্যাপী ইনতেফাদার ডাক দেওয়ার কথা বলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানে ইনতেফাদা’র কিছুটা আলোচনার অবকাশ রয়েছে। ইন্তেফাদা কী?
ইন্তেফাদা। ইন্তেফাদা আরবী শব্দ। প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, জাগরণ, আন্দোলন ইত্যাদির মিলিত অর্থ। প্রথম ইন্তেফাদা’র বহিঃপ্রকাশ ঘটে যেভাবে! ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭ কর্মক্লান্ত ফিলিস্তিনী শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার পথে তাদের দুটি গাড়িকে ইসরাইলী এক লরী চালক চাপা দেয়, এতে ৪ জন শ্রমিক ঘটনাস্থলে নিহত হন। একে উপলক্ষ করে ফিলিস্তিনীরা প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে পথে নামে। শুরু হয় প্রথম ইন্তেফাদা। প্রথম ইন্তেফাদা ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে চলমান থাকে। ইন্তেফাদা উইকিপিডিয়ায় বর্ণিত হয়েছে যেভাবে Uprising. Intifada was a sustained series of non-violent protest, acts of civil disobedience, riots and terrorist attacks carried out by Palestinians and Palestinian militant groups in the Israel occupied Palestinian territories and Israel was motivated by collective Palestinian frustration over Israel’s military occupation of the West Bank and the Gaza Strip as it approached a twenty-year mark, having begun in the wake of the 1967 Arab-Israel war. ইন্তেফাদা সর্বিক অর্থে বিদ্রোহাত্ব এক জাগরণ। এটি ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর দীর্ঘ ২০ বছরের ও অধিক সময় ধরে অধিকৃত পশ্চিমতীর, গাজার হতাশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনীদের দ্বারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অহিংস প্রচলিত আইন অমান্যকরণ, দাঙ্গা, সন্ত্রাসী আক্রমণ।
ইন্তেফাদা ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের প্রবল প্রতিবাদ হলেও তা ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের দখলদারিত্ব মোটেও টলাতে পারেনি বরং দিন দিন ইসরাইল তার দখলদারিত্ব আরো ব্যাপক বিস্তৃত করেছে। এর পিছনে কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সক্রিয় সমর্থন ইসরাইলকে বেপরোয়া করেছে কেবল। সেই কাহিনি থাকবে পরবর্তী লেখায়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।