পুকুর-দিঘি ও জলাশয় রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে

| রবিবার , ২৭ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ

নানা কারণে নগরীতে একের পর এক পুকুর ও দীঘি ভরাট করে বহুতল ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পুকুর ও জলাশয় ভরাটের মাধ্যমে পরিবেশ এবং প্রতিবেশির বহুমুখী সংকট তৈরী করা হচ্ছে। পরিবেশের সুরক্ষায় আর.এস, পিএস, ও বিএস জরিপ চিহ্নিত পুকুরগুলো উদ্ধার করার জন্য দাবি উঠেছে। চট্টগ্রাম শহরে একসময় অনেক পুকুর ও জলাশয় ছিল। জলাশয়গুলো মানুষ এবং পশুপাখির পানীয় জলের চাহিদা মেটাতো। কিন্তু হারিয়ে গেছে অনেক পুকুর। গত ২৫ জুলাই দৈনিক আজাদীতে ‘যেভাবে মৃত্যু হচ্ছে একটি পুকুরের’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, উত্তর পাহাড়তলী নোয়াপাড়া হাজী আমানউল্ল্যাহ রোডের শত বছরের ছন্দনা পুকুরটি (নোয়াপাড়া পুকুর) এখন বিলুপ্তির পথে। স্থানীয়দের অভিযোগ মসজিদের ওয়াকফ এস্টেটের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী পুকুরটি দিনদুপুরে ময়লা আবর্জনায় ভরাট করা হলেও কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করছে না। এতো বড় পুকুরটি নিয়ে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ, ফায়ার সার্ভিস, সিডিএ, স্থানীয় কাউন্সিলর কারো পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় নারীপুরুষবৃদ্ধ সকলেই। বর্তমানে এই পুকুরটি যারা ক্রয় করেছেন তারা গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে পলাতক থাকলেও প্রতিনিয়ত ময়লাআবর্জনা ফেলা কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। সরেজমিনে পুকুরটি দেখতে গেলে স্থানীয় অসংখ্য নারীপুরুষ এসময় ভিড় করেন এবং তাদের অভিযোগের কথা আজাদীতে তুলে ধরার অনুরোধ জানান। তাদের অভিযোগ স্থানীয় মাহমুদ খান জামে মসজিদের ওয়াকফ এস্টেটের এই পুকুরটির এক সময় আয়তন ছিল দেড় কানির মতো। এখন চারদিকে ভরাট করে পাকাসেমিপাকা বিল্ডিং, দোকান এবং টং দোকান করার ফলে এটির আয়তন এখন ১০ গণ্ডায় এসে ঠেকেছে বলে দাবি করেছেন ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন এবং সালমা আক্তার। এসময় মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, এই পুকুরটি আমার জন্মের অনেক আগের। আমাদের বাপদাদাদের কাছ থেকে শুনেছি এই পুকুরটি প্রায় দেড় কানি আয়তনের। এখানে আমাদের বাপদাদারা গোসল করেছেন। আমরা গোসল করেছি। এখন চারদিকে ময়লাআবর্জনা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে যাতে কেউ ব্যবহার করতে না পারে। দীর্ঘদিন পুকুরটি ব্যবহার করতে না পারার কারণে পুকুরটির মাঝখানে ঘাস লতাপাতা গজিয়েছে। যে কেউ হঠাৎ দেখলে এটিকে পুকুর বলে মনে হবে না। তিনি বলেন, এটি মাহমুদ খান জামে মসজিদের ওয়াকফ এস্টেটের সম্পত্তি। যারা মোতোয়াল্লী ছিলেনতারা ওয়াকফ এস্টেটের শ্রেণি পরিবর্তন করে এই সম্পত্তিগুলো বিক্রি করেছেন। এটা এখন কয়েক হাত পরিবর্তন হয়েছে। পুকুরের দক্ষিণপশ্চিম পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা সালমা আক্তার এবং রাবেয়া বশরী হাতজোড় করে বলেন, আমাদেরকে বাঁচান; বিল্ডিংয়ের সামনে এমন ময়লাআবর্জনার দুর্গন্ধে আমরা এখানে বসবাস করতে পারছি না। আমরা ঘর থেকে বের হতে পারছি না; ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিতে পারছি না, দরজাজানালা খুলতে পারছি না দুর্গন্ধের কারণে। দিনরাত ময়লা ফেলে চারদিক ভরাট করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নগরে পুকুর বা জলাশয় অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুকুর, খাল, নদীএসব জলাশয় নগরের প্রাণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জলাশয় না থাকলে নগরের তাপমাত্রা শুধু বৃদ্ধি পায় না, নগরে পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। কিন্তু সেই পুকুর ও জলাশয়গুলোকে কিছুতেই রক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান জরুরি। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জলাশয় সংরক্ষণ আইনসহ অনেকগুলো আইন কোনো না কোনভাবে পুকুরজলাশয় দূষণ ও দখল প্রতিরোধ, সংরক্ষণ ও রক্ষা বা এ সম্পর্কিত বিষয় উল্লেখ করেছে। কিন্তু এসব আইন বাস্তবায়নও কোনো একক সংস্থার কাছে না থাকায় আইনের বাস্তবায়ন শিথিলভাবে হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোন বাস্তবায়নই হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া দখল ও দূষণকারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শ আইন বাস্তবায়নে বাধার সম্মুখীন হয়।

যারা পুকুর, দিঘি ও জলাশয়গুলো ভরাট কিংবা দখল করেছেন ও করছেন, তাদের বেশিরভাগই আসলে লোভ ও লালসা থেকেই করছেন। ফলে পুকুর ভরাটের ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে বেআইনিভাবে এবং কখনো কখনো যোগসাজশে আইনের ফাঁক গলিয়ে। এসব ক্ষেত্রে আইন রক্ষার দায়িত্ব যে সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সে সকল প্রতিষ্ঠানকেও আমরা যথাযথ দায়িত্ব পালনে দেখছি না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রকৃতি প্রদত্ত কিংবা মানুষের সৃষ্টি করা বৈশিষ্ট্যসম্বলিত ও পুরনো পুকুর, দিঘি এবং জলাশয়গুলোকেই বেশি নষ্ট করা হচ্ছে, ভরাট ও দখল করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জরুরি। উন্নয়ন মানে পরিবেশ ধ্বংস নয়, এ ভাবনা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুধু তাৎক্ষণিকভাবে লাভবান হবার জন্যই এসব পুকুর জলাশয় ভরাট করে দখল ও ভবন নির্মাণ চলছে। এ প্রবণতা বন্ধ করা দরকার। এ ব্যাপারে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে সমন্বয় সাধন করতে হবে। বিশেষ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনকে সমন্বয়ের মাধ্যমে পুকুর, দিঘি ও জলাশয় রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে