‘ছুটির ঘন্টা’ বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র। এটি কোন গল্প হলে শুধুমাত্র সুন্দর একটি চলচ্চিত্র হিসেবে পরিচিত হতো হয়ত। কিন্তু এটি শুধুই একটি চলচ্চিত্র ছিল না, ছিল একটি মর্মান্তিক সত্য ঘটনা। ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছায়াছবির মতোই এক স্কুলছাত্র নিজ স্কুলের ওয়াশরুমে প্রায় এক মাসের মতো বন্দী ছিল এবং শেষ পর্যন্ত অনাহারে তার মৃত্যু হয়।
গত একুশ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে তা যেন দুঃস্বপ্নের মতো সারাদেশে ছেয়ে গিয়েছে। স্যোশাল মিডিয়াতে ঘটনার বীভৎস চিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একটা স্কুল, প্রাইমারি সেকশনের ছোট ছোট শিশু–সারাদিনের ক্লাস শেষ হবে। বাহিরে অপেক্ষারত মা বাবা। দিনশেষে নিজের বাচ্চাদের সারাদিনের গল্প শুনতে শুনতে একটা আইসক্রিম কিনে দিবেন। বাসায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়েই হয়তো নিজেদের প্রিয় কার্টুন দেখতে বসবে। কিন্তু এর কিছুই আর হয়নি সেদিন। কারও কারও জন্য হয়তো এমন দিন আর কখনো ফিরবেও না।
এফ–৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমান, যা দুনিয়াজুড়ে ফ্লাইং কফিন হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশের বিমান বাহিনী ত্রুটিপূর্ণ এসব বিমান ব্যবহার করেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তৌকির ইসলাম সাগর–এর মতো নতুন পাইলটদের। বাংলাদেশের প্রথম সারির নিউজ চ্যানেল এনটিভি’র তথ্যমতে, আগামী ২০২৫–২৬ বাজেটে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাজেট ধরা হবে প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। সংখ্যাটা বেশ চোখে পড়ার মতো। প্রশ্ন হলো এত টাকার বাজেট প্রতি বছর নির্ধারণের পর এখনো বাংলাদেশের বিমান বাহিনীতে প্রশিক্ষণরত অফিসাররা কেন এতটা ঝুঁকিপূর্ণ বিমান নিয়ে আকাশে উড়ছেন? যেখানে এফ–৭ বিজেআই বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার কারণ হয়েছে এবং আমরা বেশ কিছু পাইলটকে হারিয়েছি। ১৭ বছরে এফ–৭ বিমান দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৪ এর কম নয়।
অন্যদিকে আরেকটি প্রশ্ন যেটা তোলা হচ্ছে, জনবসতিপূর্ণ একটি স্থানে কেন বিমান (ফাইটার জেট) প্রশিক্ষণ চলছে? এক্ষেত্রে যে বিষয়টি এতটা উঠে আসছে না, সেটি হলো দিয়াবাড়ির ওই অংশটিতে মানুষের বসবাস শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেখানে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন দুর্নীতির বেড়াজালে গড়ে উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসনসহ বিভিন্ন বহুতল ভবন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রশাসনও কোনভাবেই এই দায় এড়াতে পারে না।
২১ জুলাইয়ের এই ঘটনাটি যদি শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা হতো, তাহলে সম্ভবত মানুষ শোক পালন করলেও এতটা ক্ষুব্ধ হতেন না। কিন্তু এটি কোন স্বাভাবিক দুর্ঘটনা ছিল না। এর পিছনে এমন কিছু কারণ রয়েছে যার সমাধান শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হয়নি। কিংবা কোনোদিন এর চেষ্টাটুকুও করা হয়নি বলেই আজ আমাদের মাঝ থেকে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেলো।
এ ধরনের দুর্ঘটনার পর জনগণ আশা করে তাদের ট্যাক্সের টাকায় চলতে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্র এর দায়ভার গ্রহণ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী মানুষদের আজ অবধি কোনোদিনও একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায়ভার গ্রহণ করে তার দায়িত্ব নিতে দেখা যায়নি। মাইলস্টোনের ঘটনার পরও মৃত ব্যক্তিদের তালিকা নিয়ে লুকোচুরির অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমগুলোর চেয়েও মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেশি বিশ্বাস করছে এবং এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কোন গণমাধ্যমই স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে নিজেদের জানা, নিজের চোখের সামনে দেখা বাস্তব সত্য তথ্যগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। গত পনের বছরের শাসনকালেও পারে নি, আজকেও পারছে না। একজন নাগরিক হিসেবে আহত মানুষগুলোর ন্যূনতম অধিকার হওয়ার কথা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসা চিকিৎসার অর্থ বহনের খবর। এর বদলে আমরা দেখতে পাই প্রধান উপদেষ্টার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পোস্ট করা অর্থ সাহায্যের আবেদন। জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের পর তা ডিলিট করা হয়। অর্থাৎ না আমাদের উন্নত প্রযুক্তি বা আধুনিক বিমান ক্রয় করার বাজেট আছে, না একটা দুর্ঘটনার পর মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বাজেট আছে। তাহলে দুর্ঘটনা–পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য গঠিত তহবিলের কাজ মূলত কি?
এই ক্ষোভ সাধারণ মানুষের এবং সেটা জায়েজ মনে হলেও রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়িত্বজ্ঞান ও অধিকারবোধ তাদের থাকার কথা অথচ নেই, সেটা অস্বীকার করার কোন জায়গা আর থাকছে না। কেননা এই সাধারণ মানুষই কোনোদিন দুর্নীতিকে প্রশ্ন করেনি বরং যখনই নিজেরা এতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন, অতি উৎসাহে সর্বস্ব লুটে নিয়েছেন। আমরা কোনোদিনও জানতে চাইনি, এত বিশাল বাজেটের সবটুকু কোথায় ব্যয় হচ্ছে। সঠিকভাবেই যদি বণ্টন হয়ে থাকে, তবে এত পুরোনো জং ধরা বিমান নিয়ে আমাদের শিশুদের স্কুলের উপর কেন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা। আমরা কোনোদিনই প্রশ্ন করিনি, কেন এত ঘনবসতি তৈরি হতে দেওয়া হলো, কারা এর অনুমতি দিচ্ছে। এসব প্রশ্ন যা এখন উঠছে তার কোনোটিই গত তিন চার দশকেও উঠেনি। এর কারণ কি হতে পারে? এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা বিন্দুমাত্রও অধিকার সচেতন নই। যেহেতু এখন একটি সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে নিজেদের বাসাবাড়ির উপর বিমান ধসে পড়ার তাই আমরা এখন প্রশ্ন তুলছি। আমরা যে নিজেদের নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব নিয়েই শুধু সচেতন নই তাও না। আমাদের দেশের আমজনতা একটি দুর্ঘটনার পর এতটুকুও জানে না যে কিভাবে সেখানে একটু দায়িত্বশীল আচরণ করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যাবে। ২১ জুলাইয়ের ঘটনার পর অসংখ্য ভিডিও ফেইসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যেখানে এমন মুহূর্তে সহায়তার আশা করা হয়, সেখানে মানুষ ব্যস্ত ছিল মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করতে। ভিডিও ধারণকৃত ব্যক্তিটি কোন সাংবাদিক নয়। তার ভিডিওতেই দেখা যায় এক দগ্ধ শিশুর দিগ্বিদিক ছুটে চলার দৃশ্য। তিনিও বাচ্চাটিকে সাহায্য করতে একবারের জন্যও এগিয়ে যান নি। কেননা একটি ভিডিও করলে প্রচুর অর্থ রোজগারের যে সম্ভাবনা, বাচ্চাটিকে সাহায্য করলে সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। অন্যদিকে মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যানবাহনের ভাড়াও বেড়ে কয়েকশ গুণ হয়ে যায়। যেখানে আমাদের মানবিকতার পরিচয় দেয়ার কথা, সেখানেই আমরা হয়ে উঠি সর্বোচ্চ স্বার্থপর। সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার কাজে এসে মৃতদের সংখ্যা লুকানোর উদ্দেশ্যে ছাত্র ও শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছে এমন অভিযোগ উঠে আসে। এক নিমিষে এত ছোট প্রাণগুলোর মৃত্যু চোখের সামনে দেখার পর আমাদের এতটুকু জানাতেও তাদের আপত্তি যে ঠিক কতজন মানুষকে আমরা হারিয়েছি। এতগুলো স্বপ্ন, বাবা মায়ের আদরের সন্তানদের কতজনই হারিয়ে গেলো কিন্তু রাষ্ট্রের ভ্রুক্ষেপ যেন শুধুমাত্র অর্ধনমিত পতাকা অবধিই। যদি সেরকম না হয়, আমরা তাহলে মৃতদের সঠিক তালিকা দেখতে চাই। আমরা জানতে চাই এত টাকা বাজেটে নির্ধারণের পর সেটা কীভাবে খরচ হয়। আমরা বুঝতে চাই, কারা বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়নের অনুমতি দিল, কেন দিল।
এ ধরনের দুর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। এসবের নাম আসলে দুর্ঘটনা না, হত্যা হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাদের রাষ্ট্রের হাতে এমন পরিকল্পিতভাবে হত্যা হয় বারবার। আমরা তবু চুপ থাকি। কিছুদিন হয়তো ঘটনাটি নিয়ে নিজেদের মাঝে হা হুতাশ চলে। কিন্তু কোনোদিনই এর পরিবর্তনের জন্য নিজেরা দায়িত্ব নেয় না। সরকার প্রধান পরিবর্তন হয়। যে দুর্নীতির মাঝে আমরা নিজেদের অভ্যস্ত করেছি, ক্ষমতার লোভ আর ক্ষমতাশীলদের ভয়ে নিজেদের অধিকার বিসর্জন দিয়েছি তার পরিবর্তন আমরা কোনোদিনই করি না।
আর যেহেতু আমরা কোন পরিবর্তন করি না, তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী আরো একটি দুর্ঘটনার অথবা কাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার। এক শিশু সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিল, আর দশ মিনিট পর স্কুল ছুটি হয়ে যেতো। কিন্তু স্কুল আর কোনোদিন ছুটি হবেনা। ছোট ছোট দেহের শিশুগুলো ছুটির ঘণ্টার অপেক্ষায় রয়ে যাবে চিরদিন। তবু রাষ্ট্রযন্ত্রের টনকের ঘন্টাটুকু নড়বে না। জনগণের মৃত্যু শুধু শোক দিবস হিসেবেই রয়ে যাবে। যাদের শ্রমের ট্যাঙে এ রাষ্ট্রের চাকা চলে, তাদের শিশুরই পোড়া দেহের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে। এ অপেক্ষার প্রহরের ছুটির ঘণ্টা কি বাজবে কোনোদিন ?